ঢাকার স্মৃতিকথা

May 22, 2025

অনুবাদক: আসিফুল আবেদীন

রেজিনাল্ড বিশপ হেবার (১৭৮৩-১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন অ্যাংলিকান বিশপ। ১৮২৩ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের লর্ড বিশপ পদে মনোনীত হন। মনোনয়নপরবর্তী দুই বছর তিনি তার অধীনে থাকা গির্জাসমূহে সফর করেন। লিপিবদ্ধ করেন দীর্ঘ সফরের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। তার সে সফরনামা পরিচিতি অর্জন করে Narrative of a journey through the upper Provinces of India from Calcutta to Bombay, 1824-1825 শিরোনামে। বাংলা ও বিশেষ করে ঢাকার নগরীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি। তৎকালীন ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াব শামসুদ্দৌলার সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন। দেখা করেন ঢাকার অন্যতম ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত পুরুষ মীর আশরাফ আলীর সঙ্গেও। এক সময়কার আভিজাত্যে মোড়া নগরী ঢাকা তখন জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে। উনিশ শতকের প্রথমার্থের ঠিক সেই সময়টাতে ঢাকা নগরীর বিবর্তন ও জনজীবন বোঝার জন্য বিশপ হেবারের সফরনামা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

৪ জুলাই

আমি গথিক শৈলীতে নির্মিত ছোট কিন্তু দৃষ্টিনন্দন গির্জায় স্বল্প সমাগমের উপস্থিতিতে ধর্মোপদেশ দিলাম। মি. প্যারিশ প্রার্থনা পরিচালনা করেন এবং পরবর্তী বুধবার ও শুক্রবারে অনুষ্ঠেয় গির্জার শুদ্ধিকরণ (কনসিক্রেশন) ও দিক্ষা গ্রহণানুষ্ঠানের (কনফার্মেশনের) ঘোষণা দেন। বিকেল ৪টার দিকে পানসি ( ছোট নৌকা) ঘাটে পৌঁছায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে স্টো খবর পাঠালেন তিনি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছেন, তার আমাশয় গুরুতর আকার ধারণ করায় তিনি নৌকা ছেড়ে উঠতে পারছেন না। আমি স্টেশনের সার্জন মি. টডকে নিয়ে তার কাছে পৌঁছলাম। তিনি স্টোকে নৌকার কেবিনের চেয়ে তুলনামূলক আলো -বাতাসপূর্ণ ঘরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে বাতাস কিছুটা শান্ত হওয়ায়, স্টো মি. মাস্টারের বাড়িতে পৌঁছে বিশ্রাম নিতে সক্ষম হন। আশা করি এর ফলে তার অবস্থার অবনতি ঘটেনি। আমাদের প্রতি মি. মাস্টারের আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয় । কিন্তু দুঃখের বিষয় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা মোটেও ভালো না।

ঢাকা যে নদীর তীরে অবস্থিত, রেনেলের মানচিত্র আঁকার সময় থেকে সেই নদীর প্রকৃতি অনেকটাই বদলে গেছে। নদীটি তখন সরু ছিল, কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমেও এটি প্রায় কলকাতার হুগলি নদীর মতোই প্রশস্ত।বর্তমানে এটি আরও বিস্তৃত হয়েছে এবং মি. মাস্টারের বাড়ির উপরের জানালা থেকে বিপরীত তীর অনেকটাই প্লাবিত মনে হয় । যদিও পানির সাথে সাথে বেড়ে উঠা সবুজ ধানক্ষেত দূর থেকে কেবল একটি জলমগ্ন ঘাসভূমির মতো দেখায় । সর্বত্র ছোট নৌকা ফসলের ভেতর দিয়ে সহজেই চলাচল করছে । ধান গাছগুলোও চলাচলের পথে তেমন বাধা সৃষ্টি করছে না।

মি. মাস্টারের ভাষ্য মতে ঢাকা আজ কেবল তার প্রাচীন ঐশ্বর্যের ধ্বংসাবশেষ মাত্র, যেমনটি আমিও অনুমান করেছিলাম । ঢাকার বাণিজ্যের হার পূর্বের তুলনায় বর্তমানে একষষ্টাংশে নেমে এসেছে । এ শহরের চমৎকার সব ভবন, যেমন- প্রতিষ্ঠাতা শাহ জাহাঙ্গীরের দুর্গ, তার নির্মিত বিরাট মসজিদ, প্রাচীন নবাবদের প্রাসাদ, ডাচ, ফরাসি ও পর্তুগিজদের তৈরি কারখানা ও গির্জাগুলি—সবই আজ ভগ্নদশায় পতিত এবং জঙ্গলে ঢেকে গেছে। মি. মাস্টার নিজে একবার পুরনো প্রাসাদের চত্বরে একটি বাঘ শিকারে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তার এক বন্ধুর হাতি আগাছা ও ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাওয়া একটি কূপে পড়ে যায়।

এ অঞ্চলে উৎপাদিত অধিকাংশ তুলাজাত কাঁচামাল ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। ইংল্যান্ডের তৈরি পণ্য তুলনামূলক অনেক সস্তা হওয়ায় ঢাকাবাসীর কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শহরটিতে এখনো কিছু আর্মেনিয়ান বসতি রয়েছে , তাদের কেউ কেউ ধনী। দুজন যাজক সমেত তাদের একটি গির্জাও রয়েছে। আর্মেনিয়ান আর্চবিশপ চার-পাঁচ বছরে একবার নাকিচওয়ান থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি বর্তমানে আমার মতো একই উদ্দেশ্যে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এখানে কিছু পর্তুগিজও আছে যারা খুবই গরিব ও অধঃপতিত । গ্রিকদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং তাদেরকে পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজদের সঙ্গে তাদের মেলামেশা অন্যদের তুলনায় বেশি এবং সরকারে অনেক নিম্নপদে তারা নিযুক্ত আছেন । বিষয়টি যথেষ্ট অদ্ভুত হলেও সত্য এখানের ইংরেজ গির্জার যাজক ও কেরানির দায়িত্বে আছেন দুজন গ্রিক। গ্রিক যাজক আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছেন। আশেপাশের কিছু নীলচাষি এবং সামরিক বা বেসামরিক প্রশাসনে দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া ইংরেজদের তেমন উপস্থিতি নেই । তবে হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যা এখনো প্রায় তিন লক্ষের কাছাকাছি বলে মি. মাস্টারের ধারণা । তিনি মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে এখানে নব্বই হাজার হিন্দু-মুসলিম বসতি রয়েছে । মি. মাস্টারের বিবেচনায় ঢাকা জলবায়ুগতভাবে ভারতের অন্যতম মৃদু জলবায়ু অঞ্চলের একটিতে অবস্থিত । ঢাকার আশেপাশে প্রবাহিত বিশাল নদীগুলো সবসময় তাপ-প্রশমক হিসেবে কাজ করে। বাৎসরিক প্লাবনের ফলে এখানকার নদীগুলোর প্রবল স্রোত জমে থাকা আবর্জনা খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলে, যেমনটা হুগলি নদীর ক্ষেত্রে ঘটে না। আশেপাশে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর উপযুক্ত এই ঋতুতে মাত্র একটি ছোট পথ রয়েছে । শুষ্ক মৌসুমেও এমন পথ খুব বেশি নেই। এ অঞ্চলে ছোট -বড় অসংখ্য নদী ছড়িয়ে রয়েছে এবং শহরের উত্তর-পূর্ব অংশের সাথে কয়েকটি বৃহৎ ও দুর্গম জঙ্গল মিলিত হয়েছে। নৌভ্রমণ এখানে খুবই জনপ্রিয় এবং এখানকার মানুষ নৌকা তৈরিতে বেশ দক্ষ। মানুষের মনে নৌভ্রমণের প্রতি আগ্রহ জাগানোর উপযোগী এখানকার চেয়ে অধিক অনুকূল পরিবেশ আমি কল্পনায়ও আনতে পারিনা। তবে ঢাকায় স্থানীয়ভাবে নির্মিত দুই মাস্তুল ও চৌকো পাল যুক্ত ছোট জাহাজ ছাড়া বড় কোনো জাহাজ আসে না। বর্ষাকালে মাঝারি আকৃতির ভারবাহী জাহাজ ঢাকায় পৌঁছাতে পারলেও, এতে কিছুটা ঝুঁকি থেকে যায়। নিজের জাহাজ বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গঙ্গার এই শাখায় প্রবেশ করার মতো যথেষ্ট প্রণোদনাও নেই । লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত ইউরোপীয় ছোট নৌযান পৌঁছেছে বলে জানা যাচ্ছে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থা ভারী জাহাজের জন্য যথেষ্ট উপযোগী নয়, তবুও অধিকাংশ নাবিক নোঙ্গর ফেলার জন্য চট্রগ্রামকেই বেছে নেয়।

চট্টগ্রাম সম্পর্কে আমি অনেক চমকপ্রদ তথ্য জেনেছি। ইসলামাবাদ শহরটি খুব একটা বড় নয় এবং এখানে ইংরেজ বসতি ঢাকার তুলনায় আরও কম। শহরটির আশেপাশের অঞ্চল মনোরম ও কাব্যিক। ছোট ছোট গোলাকৃতির খাড়া পাহাড় সবুজে ঘেরা এবং কফি, মরিচ, আঙুরলতা ও বাঁশে পরিপূর্ণ। এসব পাহাড়ের চূড়ায় সাধারণত ইংরেজদের বসবাস। তবে চূড়ায় পৌঁছানো সহজ নয়, পথগুলো প্রায়ই এতটাই খাড়া ও পাথুরে যে সেখানে গাড়ি কিংবা ঘোড়া চলতে পারে না। ফলে সাধারণত টনজনে করে (এক ধরনের চেয়ার সংযুক্ত পালকি) যাতায়াত করা হয়। এমন দুর্গম এলাকায় একমাত্র চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ বাহকরাই টনজন বহনে সক্ষম। উপকূল থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ি এলাকা যা এই অঞ্চলকে বার্মা থেকে পৃথক করেছে। পাহাড়গুলো ঘন বন ও ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত হওয়ায় ভিতর দিকে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। মি. মাস্টারের মতে এখানকার আবহাওয়ার প্রশংসা অতিরঞ্জিত। প্রকৃতপক্ষে, গ্রীষ্মে এখানকার তাপমাত্রা কলকাতার তুলনায় কিছুটা শীতল হলেও ঢাকার চেয়ে শীতল নয়। বর্ষা ও শীতের সময় আবহাওয়া হয়ে পড়ে ভীষণ শীতল, স্যাঁতসেঁতে এবং দমবন্ধকর। ক্রমাগত পরতে থাকা অস্বস্তিকর ঘন কুয়াশা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বৃদ্ধির পেছনে দায়ী । চারপাশের বিস্তৃত ঝোপঝাড় ও নিকটবর্তী পাহাড় থেকে এই কুয়াশা নেমে আসে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদেরকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা ছিল অতি সামান্য এবং এই ক্ষীণ প্রচেষ্টাও প্রায় কোনো ফল দেয়নি । ঢাকায় একজন ব্যাপটিস্ট পাদ্রি আছেন, যিনি সৎ ও পরিশ্রমী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তিনি একটি খ্রিস্টান স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন যদিও স্কুলটি মূলত পর্তুগিজ ও গ্রীক শিশুদের জন্য। স্থানীয় বাঙালিদের জন্যও তিনি কয়েকটি বিদ্যালয় স্হাপন করেছেন। কিন্তু সেগুলির পাঠ্যসূচিতে তিনি হয়তো সাহস করে নিউ টেস্টামেন্ট অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি, অথবা চেষ্টা করেও সফল হননি। এখানকার অবস্থা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এতটাই ব্যতিক্রম যে এতে তার প্রচেষ্টার ঘাটতি আছে বলেই সন্দেহ হচ্ছে। তবে তিনি ইংরেজ পরিবারগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া পেয়েছেন। সুতরাং আমার ধারণা এখানে চার্চ মিশনারির মতো কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলে একেবারে অনুপযুক্ত হবে না, বরং যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হতে পারে।

৫ জুলাই

আজ আমি ঢাকার বেশিরভাগ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। এছাড়াও নবাব শামসুদ্দৌলার সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তি, মি. লি আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে এবং আমার সঙ্গে নবাবের সাক্ষাতের দিনক্ষণ নির্ধারণ করতে এসেছিলেন। নবাব এখন অবশ্য সব ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে বসে আছেন। এমনকি তার ভাই যে রাজকীয় পালকিটি ব্যবহার করতেন, তিনি সেটির উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। তার প্রতিবেশী মুর্শিদাবাদের নবাব সে পালকিটি রেখে দিয়েছেন। তবে নবাব শামসুদ্দৌলা মাসিক দশ হাজার সিক্কা রুপি ভাতা পান। এছাড়া তিনি ‘মহামান্য’ রূপে প্রহরীসমেত একটি রাজসভা পরিচালনার বৈধতা রাখেন। পালকিটি অবশ্য এমন মর্যাদাপূর্ণ যার যৌক্তিক দাবীদার তার ভাই ও ছিলেন না ( যদিও তিনি ব্যবহার করেছিলেন) । সুতরাং শামসুদ্দৌলার পক্ষে পালকিটি দাবি করা অপ্রত্যাশিত , যেহেতু উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে। যৌবনে নবাব শামসুদ্দৌলা ছিলেন একজন অবাধ্য ব্যক্তি। সরকার ও পরিবারের সঙ্গে তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এমনকি নবাব ওয়াজির আলির রক্তক্ষয়ী ষড়যন্ত্রে তার অংশগ্রহণ ছিল। এজন্য তাকে বহু বছর কলকাতায় কারাবরণ করতে হয়েছে। দীর্ঘ কারাবাসের সময় তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিশদ জ্ঞান অর্জন করেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তার দক্ষতা সমসাময়িক অধিকাংশ স্বদেশবাসীর চেয়ে উৎকৃষ্ট। তিনি যথেষ্ট ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারেন, এমনকি তিনি নিজেকে শেক্সপিয়রের সমালোচক হিসেবে দেখেন। মি. মাস্টারের ভাষায় শামসুদ্দৌলা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন প্রখর ও অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী ব্যক্তি যিনি প্রতিভা প্রকাশের যথাযথ সুযোগ পেলে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। কিন্তু এখন তিনি বার্ধক্যে উপনীত, দুর্বল ও অলস হয়ে পড়ছেন। প্রাচ্যের অন্যান্য যুবরাজদের মতো দিনকে দিন কর্মহীন ভোগবিলাসে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। তার সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকু আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে নর্তকী এবং আফিম তার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত অর্থে তিনি এখন প্রায় সবটা সময় তার অধস্তনদের সঙ্গেই কাটান। এমনকি প্রাচ্যের অন্যান্য যুবরাজরা যেসব সাধারণ প্রেরণায় কখনো কখনো সক্রিয় হয়ে উঠেন সেসব উদ্দীপনাও তার মধ্যে অনুপস্থিত। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এমন একজন মানুষের জন্য গভীর ধর্মীয় অনুভব হতে পারে অমূল্য রত্ন। হায় আফসোস! নবাব সামসুদ্দৌলার মনে সে অনুভূতি জাগিয়ে তোলার উপায় আদৌ যদি থাকে তাও অতি সামান্যই।

সরকার সাধারণত ঢাকায় পাঁচটি পদাতিক কোম্পানির বেশি সৈন্য রাখে না। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে ঢাকাতে একটি ছোট গানবোটের বহরও পাঠানো হয়েছে যা আসার পথে রয়েছে। বর্মিরা টেকনাফের আশেপাশে যুদ্ধ-নৌকার কোনো উল্লেখযোগ্য বহর রাখলে ঢাকা তাদের সহজ শিকার হয়ে যেতে পারতো এবং এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং আমার ধারণার চেয়েও অধিক বাস্তবসম্মত। আতঙ্ক ও সন্দেহের অনেক কিছুর মধ্যে একজন হলেন বেচারা বৃদ্ধ নবাব, যাকে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং বর্মিদের কাছে খবর পাঠাচ্ছেন এমন সন্দেহ করছেন । ব্রিটিশ বাহিনীর কোনো বিপর্যয়ে নবাব খুব একটা দুঃখ করবেন না, এমন ভাবনা খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু পাঠানোর উপযুক্ত এমন কোনো তথ্য তার কাছে ছিল না যা পাঠানো ফলপ্রসূ হতো। বরং, তিনি বর্মিদের আগমনের আশঙ্কায় এতটাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে, তিনি তার পরিবারকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নিজেও মি. মাস্টারের সাথে থাকার অনুমতি চেয়েছেন, যাতে বিপৎকালীন পরিস্থিতিতে মি. মাস্টার যেখানেই যান তিনি সেখানে যেতে পারেন।

ঢাকা সম্পর্কে আবদুল্লাহ যথার্থই বলেছিল,“হাতির জন্য আদর্শ জায়গা।” কোম্পানির একটি হাতির খামার আছে যেখানে প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক হাতি রয়েছে। প্রতিবছর ত্রিপুরা ও কাছাড়ের অরণ্য থেকে নতুন হাতি ধরে আনা হয় এবং ঢাকাতেই তাদের পোষ মানানো হয়। এখানেই তাদের বন্দী জীবনের নিয়ম-কানুন এবং অভ্যাস রপ্ত করা ও ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া শিখানো হয়। যেসব হাতি উত্তর ভারতের প্রদেশগুলোর জন্য নির্ধারিত, সেগুলো কিছুদিন ঢাকায় রেখে তারপর ধাপে ধাপে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, দিনাজপুর প্রভৃতিতে স্থানান্তর করা হয়; কারণ ঢাকা থেকে মিরাট বা কানপুরে হঠাৎ স্থানান্তর করলে জলবায়ুগত ব্যপক পার্থক্য তৈরি হয় এবং এই রকম আকস্মিক পরিবর্তনে বহু হাতির মৃত্যু ঘটতে পারে। সন্ধ্যাবেলা আমি মি. মাস্টারের সঙ্গে শহরের ভেতর এবং আশপাশের কিছুটা এলাকা ঘুরে দেখলাম। শহরটি অনেকটা কলকাতার চিতপুর এলাকার সবচেয়ে বাজে অংশের মত। তবে শহরের মধ্যে কিছু চমৎকার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যেগুলি তিন-চতুর্থাংশ এলাকা জুড়ে থাকা কুঁড়েঘরের ফাঁকে-ফাঁকে ছড়িয়ে আছে। যে দুর্গটি আমার নজর কেড়েছিল সেটি একসময় রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো । দূর্গটি ইটের তৈরি এবং তার গায়ে লাগানো আস্তরণের চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। এই শহরের স্থাপত্য একেবারে মস্কোর ক্রেমলিনের মতোই। শহরটি ঘুরে বেড়ানোর সময় বারবার মস্কোর কথাই আমার মনে পড়ছিল। যেসকল গ্রিক বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ আমি লক্ষ্য করেছি, সেগুলো আধুনিক বাসস্থান এবং সদ্যপ্রয়াত নবাবের প্রিয় ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে নদীর আগ্রাসনে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি স্তম্ভ সদৃশ একটি স্থাপত্য দেখেছি যাকে স্থানীয় ভাষায় “মঠ” বলে। মঠটি একজন হিন্দু নির্মাণ করেছিলেন। হিন্দুদের ধর্মীয় পুণ্যকর্ম হিসেবে মঠ নির্মাণের প্রথা ভারতে প্রায়শই দেখা যায়। এই মঠটির নির্মাতা প্রায় ২৫ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি সূত্রে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন। শহরের কিছুটা বাইরে একই রকমের আরেকটি মঠ প্রদর্শনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ঢাকায় প্যাগোডার সংখ্যা খুবই অল্প এবং আকৃতিতেও ছোট ছোট। শহরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ায় প্রায় প্রতিটি ইটের দালানে ফার্সি ও আরবি শিলালিপি খোদাই করা আছে। এগুলোর বেশিরভাগই দেখতে অনেক পুরোনো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তেমন প্রাচীন নয়। এমনকি পুরাতন প্রাসাদটিও মাত্র দুইশত বৎসর পূর্বে নির্মিত অর্থাৎ লন্ডনের হোয়াইটহলের ব্যাংকোয়েটিং হাউসের চেয়ে প্রাচীন নয়। কলকাতার তুলনায় ঢাকার ইউরোপীয় বসতিগুলো সাধারণত ছোট ও নিম্ন মানের । অন্যদিকে, শহরের বাইরে যেসব বসতি রয়েছে সেগুলো জঙ্গল ও ধ্বংসস্তূপে ঘেরা, যার ফলে গোটা পরিবেশটাই পরিত্যক্ত ও অস্বাস্থ্যকর মনে হয়েছে। আমরা যতদূর গিয়েছি কোথাও কোনো চাষাবাদের চিহ্ন চোখে পড়েনি, শুধু দেখা মিলেছে প্রায় বিশ একর জমি পরিষ্কার করা হয়েছে নতুন সামরিক ব্যারাক তৈরি করার জন্য। সবমিলিয়ে পুরো ভ্রমণটি ছিল অপূর্ব দৃশ্যপটে পরিপূর্ণ, কিছু ধ্বংসাবশেষ ছিল সত্যিই চমৎকার এবং কয়েকটি বিশালাকৃতির অশ্বত্থ গাছও চোখে পড়েছে। নবাবের গাড়িটি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এটি একটি পুরোনো ধাঁচের ল্যান্ডো গাড়ি, চারটি ঘোড়া গাড়িটি বহন করছে। গাড়িচালক ও সহকারী দুজনের গায়ে লাল পোশাক, সঙ্গে কয়েকজন অশ্বারোহী প্রহরী এবং তাদের গায়েও লাল পোশাক। মাথায় বিশ্রী দেখতে লম্বা টুপি অনেকটা পুরোনো গ্রেনেডিয়ারদের মতো এবং টুপিগুলোর সামনের দিকে সোনালি ফলক বসানো যা খুব খারাপভাবে সজ্জিত। ভারতের অভিজাতশ্রেণী ইউরোপীয় রীতিনীতি গুলো অজ্ঞতাবশত এবং অপূর্ণভাবে অনুকরণ করে নিজেদের মহিমা হারিয়ে ফেলছে। পাগড়ি ও ঢেউ খেলানো পোশাকে একজন পূর্বদেশীয় অশ্বারোহীকে দারুণ চিত্তাকর্ষক লাগে; একইভাবে একজন রাজপুত্র যখন ঘোড়ায় চড়ে তার শ্বেতদণ্ডধারী ও উঁচু টুপি পরা জানিসারি প্রহরীদের নিয়ে আসে তখন তা আরও রাজসিক ও মনোমুগ্ধকর। কিন্তু একজন রাজপুত্র যখন একটি জীর্ণ গাড়িতে চড়ে এবং তার প্রহরীরা যখন মেলা থেকে আসা ঘোড়সওয়ার দলের মতো পোশাক পরিধান করে থাকে তখন তা কেবল হাস্যকরই নয় বরং করুণ ও দুঃখজনক বিষয়। যদিও এটাই স্বাভাবিক যে এই দুর্ভাগা রাজারা যতটুকু সম্ভব বিজেতাদের প্রদর্শীত শক্তি ও ঐশ্বর্যের প্রতীকী পোশাক ও রীতির যৎসাধ্য অনুকরণ করবে। স্টো এখানে আসার পর থেকেই খুব অসুস্থ। যদিও আজকে একটু সুস্থ বোধ করছে, তবুও এখনো এতটাই অসুস্থ যে আমি এই সপ্তাহে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়েছি।

আমি আজ এক মহিলার সঙ্গে দেখা করলাম যিনি রাজপুতানার নুসেরাবাদে কয়েক বছর ছিলেন। ভারতে সাত বছর কাটালেও তিনি একবারও কোনো যাজককে দেখেননি, এমনকি গির্জায় যাওয়ার সুযোগও পাননি। কিন্তু এই হতাশাজনক সমাজচ্যুত ধর্মজীবনের গল্প ম্লান হয়ে যায় আরেকজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান পুরুষের গল্পের সামনে। তিনি ত্রিপুরা বা তার আশপাশে কোথাও টানা উনিশ বছর আশেপাশে সত্তর মাইলের মধ্যে আর কোনো খ্রিস্টান বাসিন্দা ছাড়া এবং এমনকি আশেপাশের তিনশত মাইল জুড়ে কোনো উপাসনালয়হীন অবস্থায় বসবাস করেছেন। তিনি মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে গিয়ে ধর্মদীক্ষা গ্রহণ করতেন, দূরত্বের বিবেচনায় তার বাসা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ইয়র্ক থেকে লন্ডনের দূরত্বের সমান। এমন ঘটনা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে অন্তত নুসেরাবাদের ক্ষেত্রে আমি আশা করি একটা সমাধান বের করা সম্ভব।

৬ জুলাই

আজ সকালে নবাব তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেখা করতে এলেন, সঙ্গে ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি একজন সুঠামদেহী, সুদর্শন, বয়স্ক ভদ্রলোক যার ত্বকের ফর্সাভাব স্পষ্ট করে দেয় যে মুসলিম বিজয়ীদের উত্তরসূরিরা কতটা গুরুত্বের সাথে তাদের উত্তরাঞ্চলীয় রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করেছেন। বিশেষ করে তার হাতদুটি অনেকটা একজন ইউরোপীয় ব্যক্তির হাতের মতোই ধবধবে সাদা। তিনি কিছুক্ষণ হুঁক্কা টেনে যথেষ্ট সাবলীলভাবে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলেন। ঐতিহাসিক কিছু ইংরেজি বই থেকে উদ্ধৃতি দিলেন এবং স্পেনীয় যুদ্ধে স্যার এডওয়ার্ড প্যাগেটের ভূমিকা সম্পর্কেও নিজেকে যথেষ্ট জ্ঞানী প্রমাণ করলেন। তার ছেলের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। গায়ের রঙ অপেক্ষাকৃত শ্যামলা এবং ইংরেজিতে কথা বলতে পারার অপারগতা থেকে বুঝা যায় তার শিক্ষাজীবন যথেষ্ট উপেক্ষিত। নবাব আমাদের জানালেন ঢাকার কয়েক মাইলের মধ্যে একটি চমৎকার বুনো হাতি ঘোরাফেরা করছে এবং তার লোকজন হাতিটিকে অনুসরণ করছে। তার মতে বুনো হাতিরা সাধারণত এত কাছে আসে না। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে হাঁটার ব্যাপারেও তিনি আমাকে সতর্ক করলেন, কারণ সেখানে মাঝে মাঝে বাঘ দেখা যায় এবং সাপ তো সবসময়ই থাকেই। তিনি আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও পরিসর সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন করলেন এবং এক গ্রীক যাজকের কথাও বললেন, যিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। নবাব তাকে একজন জ্ঞানী ও সজ্জন মানুষ হিসেবে প্রশংসা করলেন। আমি নবাবকে ঢাকার পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন এগুলো তেমন পুরনো না কারণ মুসলিম শহর হিসেবে ঢাকা নিজেই তুলনামূলক ভাবে অনেক নবীন। তার পরনে ছিল সাদা মসলিনের পোশাক এবং পাগড়িতে ছিল একটি সোনার ফিতেবাঁধা ঝুলন্ত ঝালর। তার ছেলের পাগড়ি বেগুনি রেশমের তৈরি সোনার রেখাযুক্ত ও কিছু রত্ন খচিত। দুজনের হাতেই ছিল জমকালো হীরার আংটি। আমি নবাবকে “মহামান্য” বলে সম্বোধন করলাম কারণ এবিষয়ে মি. মাস্টার আগেই আমাকে সতর্ক করেছিলেন। মি. মাস্টার জানিয়েছিলেন যে নবাব এই বিষয়ে সংবেদনশীল। আমি লক্ষ্য করলাম মি. মাস্টারও সবসময় তাকে এই সম্মানটুকু প্রদর্শন করেন। পরিশেষে, আমার জন্য পান ও গুলাবজল আনা হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে অতিথিদের তা দিলাম। নবাব হাসলেন এবং বললেন, “আরে! আপনারা কর্তৃত্ববাদী লোকজন আমাদের রীতিনীতিও শিখে ফেলেছেন?” এরপর অতিথিরা উঠে দাঁড়ালো এবং মি. মাস্টার নবাবকে হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে সাহায্য করলেন। সিঁড়ির দুপাশে রৌপ্যদণ্ড হাতে তার সেবকরা দণ্ডায়মান ছিল এবং তার বাহনের চারপাশ ঘিরে ছিল অশ্বারোহী প্রহরীরা। গাড়িটি পুরনো এবং আগের মালিকের প্রতীক এখনো গাড়িটির গায়ে আঁকা আছে। গোটা আয়োজন খুব একটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। কোম্পানির সিপাহিরা বন্দুক উঁচিয়ে অভ্যর্থনা জানাল এবং নবাবের নিজস্ব অনুসারীরা উচ্চ কন্ঠে তার উপাধিসমূহ যেমন, “যুদ্ধের সিংহ!”,“পরামর্শে প্রাজ্ঞ!”,“উচ্চতম ও মহান যুবরাজ!” ইত্যাদি ইত্যাদি ঘোষণা করলো। তবে পুরো ব্যাপারটা ছিল প্রাণহীন এবং অনেকটা ইংল্যান্ডের কোনো আদালতে একজন ঘোষকের মুখস্থ পড়ার মতো, যার প্রতি কেউই আন্তরিকভাবে আগ্রহী না। তবুও, পুরো দৃশ্যটি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছিলাম, বিশেষ করে মি. মাস্টার কতটা মানবিক, শ্রদ্ধাশীল ও সদয় ছিলেন এই নিঃস্ব-সম্রাটের প্রতি। মি. মাস্টারের প্রতিটি কথা ও আচরণে যে সম্মান ফুটে উঠছিল তা যেন কোনো ইংরেজ রাজপুত্রের প্রতিও এর থেকে বাড়িয়ে হতো না।

জুলাই

স্টো আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ সকালে কিছুটা ভালো বোধ করলেও তার অবস্থা খুবই অসহনীয়। স্টো আমার সঙ্গে গ্রামের ভিতরে যাওয়ার অথবা ঢাকা ছাড়ার মতো অবস্থাতে নেই। হয়তো বেশ কিছু সপ্তাহের মধ্যেও এমন শারীরিক সক্ষমতা তৈরি হবে না। ব্যাপারটা খুবই পীড়াদায়ক। এতটা সময়ের জন্য যাত্রার মুলতবি করার মানে হলো বর্ষার মধ্যে কানপুর পৌঁছানোর সম্ভাবনা বিপন্ন করা। এছাড়াও এর ফলে এই বছরের মধ্যে পুরো ভ্রমণটা সম্পন্ন করতে না পারার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। এই ভ্রমণটির জন্য আমি নানান কারণে মনস্থির করেছি এবং ইতোমধ্যেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। এতদিন ধরে মি. মাস্টারের উপর বোঝা হয়ে থাকা আমার জন্য মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যদিও বিবেচ্য বিষয় হিসেবে তুলনামূলকভাবে গৌণ, তবুও এমন একটি যাত্রা ত্যাগ করার ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হবে সে ব্যাপারে আমি চিন্তা না করে পাড়ছি না। এই যাত্রার জন্য আমি ইতোমধ্যেই অর্থ প্রদান করেছি এবং সেই অর্থে সরকারের পক্ষ থেকে যে ভাতা পাওয়ার কথা তা একমাত্র ভ্রমণ চালিয়ে গেলে আশা করা যাবে। অন্যদিকে, আমি আমার বন্ধুকে বিপদের মধ্যে ছেড়ে যেতে চাচ্ছি না, যতক্ষণ না তাকে প্রকৃত অর্থে সুস্থ হতে দেখছি।

বিকেলে মি. মাস্টার আর আমি পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী নবাবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমরা গাড়িতে করে শহরের মধ্য দিয়ে অনেকটা পথ চললাম, তারপর কিছু জীর্ণ-শীর্ণ গাছপালা ও কুঁড়েঘরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটি পুরনো ইটের ফটকের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়লাম এক ধরনের বুনো প্রকৃতির উঠানে। মাঝখানে একটি বড় গাছ ও কিছু ঝোপঝাড়, আর চারপাশে জীর্ণ ভবন। এখানে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য একটি সৈন্যদল প্রস্তুত ছিল। তারা বেশ পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও সুশৃঙ্খল ছিল। তারা কোম্পানির স্থানীয় রেজিমেন্টের একটি দল, যাদেরকে নবাবের সম্মানার্থে প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। সামনেই ছিল আরেকটি ফটক যা প্রকৃত পক্ষেই সুন্দর ছিল। এর ভেতর খোলা প্রদর্শনী এবং সেখানে ‘নবত’ বা সন্ধ্যার সামরিক সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, যা রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক। যদিও নবাব এমন মর্যাদার ন্যায্য দাবিদার ছিলেন না তবু সরকার এখনো তাকে এই সৌজন্য প্রদর্শনে সহানুভূতিশীল। সেখানে নবাবের নিজস্ব প্রহরীরা উপস্থিত ছিল, তাদের উদ্ভট কোট আর টুপি পরে এবং তাদের সাথে ছিল রূপার দণ্ডধারী লোকদের ভিড়। এছাড়া দু’জন টনজোন ও ছাতাধারীও ছিল। তারা আমাদের ভিতরের প্রাঙ্গণে প্রবেশে সাহায্য করেছিল। এটি অল সোলসের ছোট চতুষ্কোণের তুলনায় সামান্য বড়। চারদিকে নিচু এবং অনিয়মিত, কিন্তু সুশোভিত ও পরিপাটি সাদা রঙ করা ভবন দিয়ে ঘেরা। ডান পাশে একটি সিঁড়ি যা একটি দৃষ্টিনন্দন অষ্টকোণাকৃতির হলের দিকে নিয়ে গেছে। হলটি গথিক খিলানে ভর দিয়ে দাঁড়ানো, চারদিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা এবং উঁচু গথিক জানালায় সুন্দরভাবে ভেনেশিয়ান পর্দা টানানো। এই অষ্টকোণ ঘরটি সাজানো একটি বড় গোল টেবিল দিয়ে, যা লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। চারপাশে মেহগনি কাঠের ড্রয়িংরুম চেয়ার এবং দুটি বড় ও আকর্ষণীয় উত্তল আয়না যা ঘর ও আসবাবকে দৃষ্টিনন্দনভাবে প্রতিফলিত করে। আরও ছিল দুটি লম্বা আয়না এবং কিছু রাজা, যেমন – সম্রাট আলেকজান্ডার, লর্ড ওয়েলেসলি, লর্ড হেস্টিংস, এবং ডিউক অব ওয়েলিংটনের ছাপা চিত্র। জর্জ চিনেরির আঁকা দুটি চমৎকার প্রতিকৃতিও সেখানে রয়েছে। এর মধ্যে একটি বর্তমান নবাবের এবং অপরটি তার প্রয়াত ভাইয়ের। চোখ ধাঁধানোর মতো কোনো কিছু না থাকলেও সবকিছুতেই ছিল উচ্চ রুচি ও অভিজাত্যের ভাব। নবাব, তার পুত্র, তার ইংরেজ সচিব এবং যে গ্রীক যাজকের কথা তিনি আগে বলেছিলেন সকলে দরজায় এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। নবাব নিজে আমার হাত ধরে আমাকে টেবিলের শীর্ষপ্রান্তে নিয়ে বসালেন। আমরা কিছুক্ষণ বসে ছিলাম এবং আমাদের কথোপকথন আমার প্রত্যাশার চেয়েও ভালোভাবে চলল। নবাবের জ্ঞান, চিন্তাশক্তি ও ভদ্র ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হয়ে আমি প্রাসাদ ত্যাগ করলাম। তার বাসস্থান আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক উন্নত ছিল এবং তার অশ্বারোহী প্রহরী ও বাহন ব্যতীত তার দরবারের কোনো কিছুই আমার কাছে নিম্নমানের মনে হয়নি। এই সাক্ষাৎকারের শেষে আমাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হলো, যদিও দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়নি। আমি জানালাম যে এটি আমার জন্য আনন্দের বিষয় এবং ইঙ্গিত দিলাম যে খুব শীগ্রই হলে আমার জন্য সুবিধাজনক। যদি এতে আমার যাত্রায় বিলম্ব না ঘটে তাহলে নৈশভোজটি আমার খুব ভালো লাগবে।

ঢাকা প্রায়শই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে, যদিও তা খুব একটা গুরুতর ভাবে না। গত বছর মি. মাস্টারের বাড়ি বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানকার ইউরোপীয়দের গড় বাড়িঘর কলকাতার দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির বাড়িঘরের সমতুল্য এবং ভাড়াও প্রায় একই রকম। খুব কম বাড়িই সরাসরি নদীর পাড়ে। তবে যেগুলো আছে সেগুলিই সবচেয়ে ভালো এবং দামও বেশি।

২২ জুলাই

অনেকটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে, আমার ডায়েরি লেখার মতো সময় এবং ইচ্ছে কোনোটিই ছিল না। আমার প্রিয় ও সৎগুণসম্পন্ন সুহৃদ স্টোর অসুস্থতা ও মৃত্যুশয্যায় তার সেবা করে এবং পরবর্তীতে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও সম্পত্তি-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থেকেছি সারাটা সময়ই। যে ভদ্রমহিলার জন্য আমি এই পৃষ্ঠাগুলো লিখছি, তিনি নিশ্চয়ই আমাকে এই বিয়োগান্তক কাহিনি পুনরায় বলার থেকে অব্যাহতি দেবেন।

দীর্ঘ আঠারো দিন অবস্থান করে আজ সকালে আমি ঢাকা ত্যাগ করেছি। এই সময়টা আমার জীবনে গভীর উদ্বেগ ও বিষাদের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কিন্তু এই দিনগুলোতে আমি ও আমার প্রয়াত বন্ধু যে সহানুভূতি, আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা পেয়েছি প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে, আর সর্বোপরি আমাদের শ্রদ্ধেয় নিমন্ত্রণকর্তা জনাব মাস্টারের কাছ থেকে, তা কোনোদিন ভুলবার নয়। তাদের প্রতি আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।

এই দীর্ঘ বিরতিতে আমি বিশেষ কিছু দেখেছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ে না, কারণ আমি প্রায় পুরোটা সময় রোগ-শয্যারত বন্ধুর পাশে ছিলাম। ৯ তারিখ, শনিবার আমি প্রায় বিশ জনকে দীক্ষা প্রদান করেছি। তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় সকলেই সমাজের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ। পরদিন রবিবার আমি গির্জার শুদ্ধিকরণানুষ্ঠান পরিচালনা করেছি, যদিও প্রথানুযায়ী তা দীক্ষাগ্রহণানুষ্ঠানের পূর্বে হওয়া উচিত ছিল। প্রথার ব্যতিক্রমের ফলে দীক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তিরা তৎক্ষণাৎ ইশ্বরের পবিত্র ভোজে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তারা সবাই তা গ্রহণ করেছিলেন। আমার বিশ্বাস স্টেশনের অন্যান্য অধিবাসীরাও এতে অংশগ্রহণ করেছিল। মোট অংশগ্রহণকারী ছিল ৩৪ বা ৩৫ জনের মতো এবং আমি কখনো এত মনোযোগী ও আন্তরিক উপাসক দেখিনি। এই অনুষ্ঠানে মূলত স্টোর ধর্মোপদেশ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়েছে।

সন্ধ্যাবেলা আমি কবরস্থান পবিত্র করি। কবরস্থানটি শহরের বর্তমান জনবসতি থেকে প্রায় এক মাইল দূরে উঁচু প্রাচীরঘেরা, একটি পুরোনো মুরীয় ধাঁচের ফটকসহ নির্জন, বন্য ও বিষণ্ণ স্থান এবং চারপাশজুড়ে ধ্বংসস্তূপ আর ঘন জঙ্গল। স্থানটি বিস্তৃত এবং কবরস্থান হিসেবে বেশ উপযোগী। এখানে কবরের সংখ্যা খুব কম, আর যেগুলো আছে সেগুলোও বেশ পুরোনো। এগুলো তখনকার সময়ের যখন ঢাকার বাণজ্যিক সমৃদ্ধি ছিল তুঙ্গে এবং ইউরোপীয় বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি। ১৭২৪ সালের জুলাই মাসে সমাহিত হওয়া একটি কবর দেখানো হলো আমাকে, যা কোম্পানির যাজক মি. প্যাগেটের। তখন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি কতটা অদ্ভুতভাবে তার সমাধির শতবর্ষ পূর্তি একদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে!কিছু কবর অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। বিশেষভাবে একটি কবর মুসলমান পীরদের মাজারের মতো দেখতে। কবরটিতে উঁচু অষ্টভুজাকৃতির গথিক মিনার এবং এর ওপরে গম্বুজ, আর আটটি জানালায় সূক্ষ্ম কারুকাজ। ভিতরে শিলালিপি বিহীন তিনটি ফলক মৃতদেহের উপর স্থাপিত। কবরস্থানে কর্মরত বৃদ্ধ দারোয়ানের ভাষ্য মতে এটি “কোম্পানির কর্মচারী কলম্বো সাহেবের” কবর। কে ছিলেন তিনি সে বিষয়ে জানা যায়নি এবং নামটিও ইংরেজদের মতো নয়। যেহেতু কোনো শিলালিপি নেই, সুতরাং দারোয়ানের ভাষ্যই একমাত্র প্রমাণ। আরেকটি কবর একজন চীনা খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ব্যক্তির, ধারণা করা হয় তিনি প্রায় একশো বছর আগে ঢাকায় বসবাস করতেন। বাকি কবরগুলো নানা সময়ের কিন্তু তেমন পুরোনো নয়। কবরগুলো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শৈলীতে তৈরি, দেখতে কিছু পিরামিড আকৃতির এবং কিছু স্তম্ভের মতো। সবগুলো কবরই চিরহরিৎ লতা ও বিধ্বংসী অশ্বত্থ গাছে আচ্ছাদিত। কবরস্থানের চারপাশে আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে কিছু বিশাল হাতি তাদের মহাওতের (হাতির চালক, প্রশিক্ষক বা রক্ষক) সঙ্গে গাছ-গাছালি খাচ্ছিল। আর স্হানীয় গরুগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘাসে ঢাকা ছোট ছোট প্রান্তরে। এগুলো না থাকলে পুরো এলাকা হতো এক অনতিক্রম্য অরণ্য। পুরো দৃশ্যটি এতটাই গভীর, বুনো ও বৈচিত্র্যময় ছিল যে, সে দৃশ্য সময়ের অভাবে চিত্রায়ণ করতে না পারায় খুবই আফসোস হচ্ছে।

একদিন সন্ধ্যায় আমি মি. মাস্টারের সঙ্গে কয়েদখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আমরা প্রথমে মানসিক রোগীদের জন্য নির্ধারিত একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করি। সরকার মানবিক উদ্যোগে প্রতিটি জেলায় এমন ব্যবস্থা রেখেছে। এসকল আশ্রয় কেন্দ্রে নারী বা পুরুষ, নিরাময়যোগ্য বা দুরারোগ্য রোগীদের আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। একজন ইংরেজ সার্জন এবং কয়েকজন স্হানীয় ডাক্তার সবকিছুর তত্ত্বাবধান করেন। জায়গাটি খোলামেলা, আলো-বাতাসপূর্ণ ও আবহাওয়ার বিবেচনায় যথোপযুক্ত, যার ফলে রোগীরা মোটের উপর ভালোই ছিলেন। আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখে প্রশংসা করার সময় মি. মাস্টার আমাকে বললেন, “সম্ভবত ওরা আমাদের আসার খবর পেয়েছিল।” কিন্তু রোগীদের কোনো অভিযোগ আছে কিনা সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেকেই খুব সাবলীল ভাবে বলল তাদের অন্যায় ভাবে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের দাবি তারা প্রমাণ করতে পারবে তারা কখনো পাগল ছিল না, অথবা তারা এখন পরিপূর্ণ ভাবে সেরে উঠেছে। মাত্র দুজনকে দেখে বিপজ্জনক মনে হলো এবং তাদেরকে লোহার গরাদে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের হাতে হালকা শিকলও ছিল। একজন তো থামছিলই না এবং উন্মাদনার ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছিল, আর বারবার প্রহরীদের হুমকি দিচ্ছিল। সে একজন ব্রাহ্মণ শিক্ষক যে নিজের ভাইকে খুন করেছে। আরেকজন চুপচাপ শুয়ে ছিল, মাঝে মাঝে নিচু স্বরে কিছু একটা বলছিল। মি. মাস্টারের মতে সে অভিশাপ দিচ্ছে। সে একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক এবং কয়েকবার নিজের স্ত্রী-সন্তানদের খুন করার চেষ্টা করেছে। সেখানে যারা ছিল তাদের অধিকাংশের প্রধান সমস্যা বিষণ্নতা বা মানসিক দুর্বলতা। এখানে আত্মীয়রা কিছু খরচ দিয়ে রোগী পাঠাতে পারে। অন্যদিকে গরিব কেউ যদি বিপজ্জনক বা অস্বস্তিকর আচরণ করে তখন “পরগনার” দারোগা তাকে ধরে এখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

জায়গা বহুল, শুষ্ক ও আলো-বাতাসপূর্ণ কামরা নিয়ে কারাগারটি খুবই পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন। বন্দিরা প্রতিদিন একবার খোলা মাঠে গিয়ে নিজেরা রান্না করতে পারে। তবে দেয়াল নিচু হওয়ায় ওদের সকলকে শিকলে বেঁধে রাখতে হয়। এই শিকল বাঁধা অবস্থা দেখে বাজে মনে হলেও বদ্ধ ঘরের পরিবেশের তুলনায় এই খোলা হাওয়া অনেক ভালো। বন্দিরা খাদ্যের অনুপাতের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছিল। মি. মাস্টার আমাকে জানালেন বর্তমানে চালের অভাবের কারণে রেশন কম। পূর্বে রেশনের অনুপাত এত বেশি ছিল যে একজন সাধারণ শ্রমিকের পক্ষেও সে পরিমাণে রোজগার করা অসম্ভব ছিলো। কিছু বার্মিজ বন্দিও ছিল সেখানে। কয়েকজন দেনাদার আর বার্মিজ বন্দীরা ছাড়া সবাই শিকল-বাঁধা ছিল। গুপ্তচর সন্দেহে কোনো অস্ত্র ছাড়াই এই বার্মিজরা ধরা পড়েছিল কারণ তারা ভালোভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তাদের দেখে বোঝা যায় তারা নিরীহ কৃষক। মি. মাস্টার মনে করেন তারা সম্ভবত মনিপুর সীমান্তে লবণ ও হাতির দাঁতের চোরাচালানের সাথে কিছুতা জড়িত। তিনি তাদের মুক্তি দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন। মাঝারি গঠনের সুঠাম দেহী এসব লোকদের চেহারায় স্হানীয় ও চীনা বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ লক্ষণীয়। তাদের শরীরের অনেকটা অংশ ট্যাটু করা। দেনাদাররা সংখ্যায় অনেক এবং তাদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। যতদিন তারা বন্দি থাকে ঋণদাতারা তাদের খরচ বহন করে। কিন্তু, হিন্দু ঋণদাতারা (যেমনটা মি. মাস্টার বলেছেন এবং ড. কেরি পূর্বেই উল্লেখ করেছেন) সাধারণত এতটাই নিষ্ঠুর যে প্রতিশোধের আনন্দকে তারা টাকাপয়সার চেয়েও বড় মনে করেন। এখানে কয়েকজন প্রবীণ দেনাদার আছেন যাদের কেউ কেউ বহু বছর যাবৎ বন্দি।

আরেক সন্ধ্যায় আমি মি. মিটফোর্ডের দারুণ একটি নৌকায় চড়ে “পাগলা পুল” নামে একটি জায়গায় গিয়েছিলাম, যা ঢাকা শহর থেকে চার মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি ধ্বংসাবশেষ। এটি টিউডর গোথিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। দারুণ সমৃদ্ধ ও নান্দনিক এই স্থাপত্য আদৌ এশীয় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, কারণ মাঝিদের ভাষ্য মতে জনশ্রুতি অনুযায়ী এটি একজন ফরাসি ভদ্রলোক নির্মাণ করেছিলেন। স্যার চার্লস ড’অয়েলির Ruins of Dacca বইতে এই স্থাপনাটির একটি নিখুঁত ও চমৎকার খোদাইচিত্র রয়েছে।

ঐ সপ্তাহে এচমিয়াজিনের (আরারাত পর্বতের নিকটবর্তী) আর্মেনিয়ান আর্চবিশপ, একজন সহকারী বিশপসহ আমার সঙ্গে দুইবার দেখা করতে এসেছিলেন। তারা আর্মেনীয়চার্চ সম্প্রদায়ের পারস্য ও ভারতীয় সব গির্জা ঘুরে দেখার জন্য সফরে বের হয়েছেন। আর্চবিশপ অত্যন্ত ভদ্র, মৃদুভাষী ও বুদ্ধিমান মানুষ। তার জেরুজালেমের সফর সঙ্গী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও চটপটে। আমি তাদের প্রতি যতটা সম্ভব সম্মান প্রদর্শন করতে চেয়েছিলাম। সমস্যা হলো তারা কেবল তুর্কি ও নিজেদের মাতৃভাষাতেই কথা বলতে পারেন। সৌভাগ্যবশত, ঢাকায় বসবাসরত তাদের সম্প্রদায়ের একজন সদস্য দোভাষীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারপর রুশ ভাষা সম্পর্কিত আমার পূর্বপরিচয় ও স্মৃতির সাহায্যে বেশ ভালোভাবে কথা চালিয়ে যেতে পারলাম। তারা দু’জনেই জর্জিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। জেরুজালেমের অধিবাসী আব্রাহাম , মজদক, নাখিচেভান, কালোমনা এবং মস্কোতেও গিয়েছিলেন। আমি তাদেরকে কিছু ছোটখাটো ব্যাপারে সাহায্য করতে পেরেছি, আর সবশেষে আমরা একে অপরকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলাম।

আমি বিদায় জানাতে নবাবের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে গেলাম (২০ জুলাই)। তার সৌজন্য ছিল সত্যিই অতুলনীয়। শেষ এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই তিনি ফলের ঝুড়ি, রান্না করা খাবার ও মিষ্টান্ন পাঠিয়েছেন (এ অঞ্চলের প্রচলিত সৌজন্য স্বরূপ) যেগুলোর কিছু ছিল আমার জন্য, আর কিছু বিশেষভাবে আমার অসুস্থ বন্ধুর জন্য সুপারিশকৃত। প্রতিদান স্বরূপ আমি যা দিতে পেরেছি তার মধ্যে সবচেয়ে অর্থবহ ও হৃদয় থেকে আসা উপহার ছিল আমার হিন্দুস্তানি ভাষায় অনূদিত প্রার্থনার বই। বইটি চমৎকারভাবে বাঁধানো ছিল এবং ভেতরে এমন অনেক কিছু ছিল, যা একজন মুসলমানের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হওয়ার কথা নয়। আমি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, খোদা যেন এটিকে তার কল্যাণে কাজে লাগান। যদিও বিষয়টি “জলে রুটি ছড়িয়ে দেওয়ার মতো” এবং তাও আবার ভোগ-বাসনা ও কুসংস্কারে উত্তাল অন্ধকার সমুদ্রে। বেচারা বৃদ্ধ! আমি যদি জানতে পারতাম তিনি মাঝেমধ্যে বইটি খুলে দেখেন, তবে সত্যিই আমার খুব ভালো লাগতো । যদিও শেষ সাক্ষাতের সময় স্বেচ্ছায় তিনি এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমরা একান্তে রাজনীতি ও নানা বিষয়ে অনেক কথা বললাম । কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখতে বললেন। তিনি তারপর বললেন, ‘আমি আপনাকে কোনো দামী উপহার দিতে পারছি না, তবে কিছু সাধারণ জিনিস দিচ্ছি, যেগুলো এখানে সাধারণ, কিন্তু ইউরোপে দুর্লভ ও কৌতূহলোদ্দীপক হবে। অনুগ্রহ করে এই মসলিনটি আপনার স্ত্রীকে আমার তরফ থেকে উপহার হিসেবে দিবেন, আর যেহেতু আপনি এখন কিছুটা খুড়িয়ে চলছেন (সূর্যের প্রভাবে আমার পায়ে তখনো ব্যথা ছিল), আপনার ছড়ির বদলে এটি ব্যবহার করুন।’ মসলিনটির গুণাগুণ আমি তেমন জানিনা , কিন্তু ছড়িটি সত্যিই দারুণ। এটি একটানা হাতির দাঁতের তৈরি, দৃষ্টিনন্দন খোদাই করা। এটি আমার চলার জন্য হয়তো একটু বেশিই সুন্দর, তবে আমি এটিকে সর্বদা অমূল্য স্মৃতি হিসেবে যত্নে রাখব। আমার আগমন ও বিদায় দুটোই সম্পন্ন হলো সশস্ত্র অভিবাদনের মাধ্যমে।

আমি নবাবের প্রাসাদ থেকে এই জেলার প্রধান মুসলিম ভদ্রলোক মীর আশরাফ আলির বাসভবনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। মি. মাস্টারের ভাষায় তিনি অতীতে কিছুটা অপচয়ী ও দুর্ভাগা ছিলেন, ফলে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে বেশ চাপের মধ্যে আছেন। তবে এখনও তার জমির পরিমাণ তিন লক্ষ বিঘার অধিক। তার পরিবার ভারতবর্ষের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পরিবারের একটি (ব্যক্তিগত সম্পত্তির দিক দিয়ে)। মীর আশরাফ আলি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তার অন্য এক বাসভবনে ছিলেন। তবে তার দুই বড় ছেলে পূর্বেই সৌজন্য সাক্ষাৎ দিয়ে গিয়েছিলেন এবং খুবই আন্তরিক ছিলেন। তারা আশা পোষণ করেছিলেন যে আমি তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করবো। তাছাড়া, এমন একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ির ভিতরটা দেখার ইচ্ছাও আমার ছিল। মীর আশরাফ আলির বাড়িটি একটি প্রাঙ্গন ঘেরা। দেখতে অনেকটা ভাঙা-চোরা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো, যেন সেখানে কোনো অশ্বারোহী সৈন্যদল অবস্থান করছে। বাড়িতে প্রচুর উন্নত জাতের ঘোড়া এবং বহু চাকর-বাকর রয়েছে। তাদের পোশাক দেখতে চমকপ্রদ হলেও বেশ অগোছালো ও অবহেলিত। সব মিলিয়ে এখানে অদ্ভুত জাঁকজমক ও উদাসীনতা মিশ্রিত পরিবেশ বিরাজ করছে। দুই তরুণ এবং তাদের এক আত্মীয়, যাকে দেখে তাদের শিক্ষক ও পিতার ব্যবসার দেখভালকারীর মতো মনে হল, তারা আমাকে কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালেন। তারা নিজেরা বেশ অগোছালো ও অপরিচ্ছন অবস্থায় ছিলেন এবং অতিথি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবু তারা আমাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বিন্দুমাত্র অজুহাত না দেখিয়ে আমাকে একটি সাধারণ সিঁড়ি বেয়ে তাদের দৈনন্দিন বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরগুলো খুব ভালোভাবে সাজানো ছিল এবং নিচে অবস্থান কালে যেমন অনুমান করেছিলাম তার তুলনায় অনেক বেশি ভালো ও রুচিসম্মত আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ ছিল। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর, আমি আমার দোভাষী আব্দুল্লার সহায়তায় কথা চালিয়ে গেলাম। তারা খুব স্বাভাবিকভাবে ও আগ্রহভরে কথা বললেন, আর জানালেন তাদের পিতা আমাকে পরেরবার ঢাকায় এলে দারুণ শিকার দেখাবেন। মীর আশরাফ আলির বাঘ, চিতা, এবং এমনকি বন্য হাতির জন্যও শিকারক্ষেত্র রয়েছে। কথার একপর্যায়ে তারা “রৌপ্যদণ্ড” চেয়ে বসলেন! তারা বললেন, তাদের পিতার সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার অভ্যাস নেই, কিন্তু এটা বড় অন্যায় যে কলকাতার বাবুরা অভিজাত উপাধি ও প্রতীক পায়, অথচ প্রকৃত সৈয়্যদরা, যারা কিনা নবীর বংশধর এবং যাদের পূর্বপুরুষরা কখনো ব্যবসায় মনোযোগ দেননি, বরং তলোয়ার দিয়ে মূর্তিপজকদের কাছ থেকে এই ভূমি জয় করেছিলেন, তাদেরকে এখন উপেক্ষা করা হচ্ছে । আমি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, এ বিষয়ে আমি কিছু করতে পারব না। আমি আরও বললাম রৌপ্যদণ্ড থাকুক আর না থাকুক একটি পুরনো বংশ সবসময় সম্মানিত এবং প্রথম প্রথম কেউ যখন অলংকার পরে, তখন তা দেখে কেউ মোহিত না হয়ে বরং উপহাস করে। তখন ছোট ভাইটি বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়েও রৌপ্যদণ্ড ছিল, এখনও আমাদের বাড়িতে সেগুলো আছে।” আমি তাদেরকে বললাম যদি তারা সেটা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে সরকার হয়তো বিষয়টি বিবেচনা করবে। কিন্তু তাদেকে মি. মাস্টারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য বললাম, যেহেতু তিনি তাদের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রস্থানের সময় তারা একটি অত্যন্ত প্রাচীন ও কারুকার্যমণ্ডিত বোতলে পান ও গোলাপজল আনলেন। বোতলটি দেখতে সত্যিই এমন এক যুগের স্মারক বলে মনে হচ্ছিল, যখন তাদের পূর্বপুরুষরা মূর্তিপূজকদের বিরুদ্ধে তরবারি চালাতেন। পরবর্তীতে মি. মাস্টার জানালেন যদি মীর আশরাফ আলি নিজে উপস্থিত থাকতেন, তবে আমাকে এমন অনুরোধে বিব্রত হতে হতো না। মীর আশরাফ আলি প্রকৃতপক্ষেই ভদ্রলোক এবং একজন গর্বিত মানুষ। রৌপ্যদণ্ড পাওয়ার ইচ্ছা তার থাকলেও, কোনো অপরিচিত ব্যক্তির কাছে সে বিষয়ে অনুরোধ জানানো তার অভ্যাসে নেই। তার দুই ছেলে পরবর্তীতে আমাকে নৌকায় বিদায় দিতে এসেছিল। তারা আমার সন্তানদের জন্য কিছু খেলনা এবং এখানকার মুসলমানরা যেসব ভ্রমণ টুপি পরে, সেরকম একটি টুপি উপহার দিয়েছিল।