২০১১ সালের এপ্রিলে বাদশাহ ফয়সাল রিসার্চ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার এবং সৌদিতে অবস্থিত অস্ট্রিয়ান দুতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় আমার বাবার জীবন ও কর্মের উপর এক আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। যদিও উক্ত কনফারেন্সের মুল বিষয়বস্তু ছিল ‘মোহাম্মদ আসাদ- এ লাইফ ফর ডায়ালগ নামে।’ কিন্তু উদ্যেক্তরা আমাকে ‘মোহাম্মদ আসাদ – বিটুউইন রিলিজিয়ন এন্ড পলিটিক্স’ নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করে। দুর্ভাগ্যবশত ঐ সিম্পোজিয়ামে আমি যোগ দিতে না পারায় আমার লেখাটি অন্য কাউকে দিয়ে উক্ত সভায় উপস্থাপন করার জন্য পাঠিয়ে দেই। ঐ লেখাটি এখানে সংশোধিত ও বর্ধিত আকারে দেয়া হলো।
আমার বাবার জীবন ও কর্ম নিয়ে আগ্রহীদের মাঝে একটি বদ্ধমূল ধারনা রয়েছে। তারা আমার বাবার ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়টি ইসলাম ও পশ্চিমা দুনিয়ার মাঝে সম্পর্কের সেতুবন্ধন আকারে দেখে থাকে। যাইহোক এই প্রচলিত ভুল ধারনাকে সংশোধন করার মধ্যে দিয়েই আমার আলোচনা শুরু করা দরকার। এমনকি কেউ কেউ তাকে ইউরোপীয়ান বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং বলে থাকে যে, তিনি নাকি ইসলাম গ্রহন করেছেন ইসলামকে উদারিকিকরন করার মতলব-ফিকির নিয়ে। তাকে নিয়ে এসব কথাবার্তা আসলে সত্য নয়। তিনি যখন ইসলামকে (আরবী ‘আসলামা’ এর অর্থ হলো আত্মসমর্পন করা) আলিঙ্গন করে নিয়েছেন, তিনি এমন এক সমৃদ্ধ ও সামগ্রিকভাবে বিকশিত ধর্মীয় ঐতিহ্যে নিজেকে দাখিল করেছেন যা পনেরশ বছর ধরে বিভিন্ন চিন্তা ও তৎপরতার মধ্যে দিয়ে, পারস্পরিক বুঝাপড়া ও বিরোধের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। তিনি তার নিজের জীবনে সম্পাদিত কাজকর্মে মধ্যযুগের স্প্যানিশ ধর্মতাত্ত্বিক আবু মোহাম্মদ ইবনে হাজমের কর্মপদ্ধতি অনুসরন করতে চেয়েছেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মিসরীয় ইসলামী সংস্কারক মোহাম্মদ আবদুহুর চিন্তাধারা তার লেখাজোখায় প্রায়শ এবং ব্যাপকভাবে উল্লেখ করতেন । এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে জোরালো দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও, চতুর্দশ শতাব্দীর সিরিয়ান ধর্মতাত্ত্বিক তাকি আদ দীন আহমেদ ইবনে তাইমিয়ার মতো তিনিও যুক্তিবোধ (আকল), ঐতিহ্য (নাকল) এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা (ইরাদাকে) সমন্বয় করার মধ্য দিয়ে ইসলামের সুসঙ্গত ও স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে কার্যকর কর্মপন্থা গঠন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এছাড়া সুফিজম নিয়ে তার মতামত ইবনে তাইমিয়া দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি মনে করতেন, সুফিজমে মৌলিক চিন্তার চেয়ে বরং সুফিদের প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বেশি। মুলত এটিই ছিল তার সমালোচনার জায়গা। আমার বাবা জীবনের শুরুর দিকে যেসব বই প্রকাশ করেন ( যেমন ইসলাম এট দ্যা ক্রসরোড, সহীহ আল বুখারীর অনুবাদ এবং আরাফাত সাময়িকী ইত্যাদি) অধিকাংশ বই পশ্চিমাদেরকে নয় বরং মুসলমান ভাইদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। অতএব, আমি বলবো, তিনি খুব কমই ইসলাম ও পশ্চিমাদের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধন নিয়ে ভাবতেন। বরং নিজেকে সচেতনভাবে ইসলামের ঐতিহ্যে- যে ঐতিহ্য তার নিজস্ব, তাতে অধিক পরিমানে মশগুল থাকতেন। তাছাড়া তিনি যেটাকে ইসলামের আসল চিন্তা বলে বিবেচনা করতেন সে অনুযায়ী তার সম্প্রদায় তথা মুসলিমদের খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ছিলো তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ যেখানে তিনি অমুসলিমদের বিষয়ে ( এবং অবশ্যই মুসলিমদের নিয়েও) আলোকপাত করেন। মুলত এটি এমন একটি কাজ ছিল যেখানে তার পাঠকদের কাছে তিনি কীভাবে মুসলমান হয়েছেন কেবল তাই নয় বরং ইসলাম সম্পর্কে তাঁর যে দুর্দান্ত চিন্তাভাবনা ছিলো, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার জীবনের শেষবেলায় এসে তিনি কোরানের ইংরেজী অনুবাদের কাজ সমপন্ন করেন। এটি নিছক কোনো তরজমা ছিল না, বরং ইসলাম নিয়ে তার চুড়ান্ত ভাবনার বিস্তারিত উপস্থাপনা ছিল।
আমার বাবা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি একজন ধর্মীয় চিন্তক ছিলেন। তার মতে, কোরান ও সুন্নাহয় ‘মানুষের জীবন যাপনের জন্য নিঁখুত পরিকল্পনা’ সাজানো আছে। মুলত এই চিন্তার উপর ভিত্তি করেই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে লিখেছেন এবং পাকিস্থানে ইসলামী সংবিধানের জন্য প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছেন। এসব প্রস্তাবনা তার সুপরিচিত বই ‘প্রিন্সিপাল অব স্টেট এন্ড গভর্মেন্ট ইন ইসলাম’ ( ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিমালায় ) বিশদভাবে ব্যাখা করা হয়েছে। কিন্তু জীবনের পরবর্তী বছরগুলোতে কোরান অনুবাদের কাজে গভীরভাবে মনোনিবেশ করায় ইসলামি রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে তার উক্ত আগ্রহ ও তৎপরতায় ভাটা পড়ে। অধিকাংশ চিন্তকদের মত তিনিও দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন ( প্রায় ৯২ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন)। যারফলে ঐসব চিন্তকদের মত তার চিন্তা ও মতামত পরিস্থিতির পরিবর্তন ও প্রতিফলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠে এবং বিকশিত হয়। সু্তরাং আমি এখানে তার এই জীবন যাত্রার পূর্ণ সন্ধান বের করে আনতে সক্ষম নই। তা স্বত্ত্বেও আমি চেষ্টা করব, তার মৃত্যুর দুই দশক পরে এসে, যেসব কথা তিনি বলেছেন, যতকিছু লিখেছেন, সেসবের আলোকে ইসলাম নিয়ে তার মোলিক দর্শনকে আমার নিজের ধারনা ও বিশ্বাসের আলোকে এখানে ব্যাখা ও পুনরায় উপাস্থাপন করার। তার লেখালেখির কিছু বিষয়ে দ্বিমত করার পাশাপাশি, যা আমি দরকারি বলে মনে করি, কিন্তু তার চিন্তায় সেসব অস্পষ্ট ছিল, তা এখানে সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
ইসলাম নিয়ে আমার বাবার জীবনের প্রথম এবং সবথেকে গুরুত্বপুর্ণ দর্শন হলো, তার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ইসলাম চিন্তা ও যুক্তির উপর স্থাপিত। সুতরাং মুসলিম হওয়া এবং হয়ে উঠার জন্য চিন্তা ও যুক্তি জরুরী। আমি যখন ছোট ছিলাম তিনি প্রায়শ বলতেন, অন্য মুসলিম কিম্বা অবিশ্বাসীকে জোরাবলি করে নয় বরং চিন্তা ও যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। আর ‘লা ইকরাহা ফি দ্বীন’ ( ধর্ম নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নাই ) বলতে কোরান তাই বুঝিয়েছে। তিনি প্রায় বলতেন, কোরানে আল্লাহ সর্বদা মানবজাতিকে যুক্তি দিয়ে সম্বোধন করেন। যদি তুমি কোরান খুব খেয়াল করে পড়ো তাহলে উপলদ্ধি করতে পারবে কোরান সবসময় কৌতুহল জাগানিয়া প্রশ্ন তুলে যুক্তিতর্কের সাথে যুক্ত থাকে। যুক্তির মারফতেই কোরান তাঁর শ্রোতাদের সম্বোধন করে এবং বুঝানোর চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে চিন্তাশীল কায়দায় কোরান সমগ্র মানব জাতিকে (আইয়ূহান নাস) সম্বোধন করে আবার অন্য জায়গায় বিশেষ করে বিশ্বাসী মুসলমানদের (আইয়ুহাল মুমিনীন) সম্বোধন করে। মুলত কোরান এর শ্রোতাদেরকে এই ধরনের আহবানের মধ্যে দিয়ে অন্যদের জীবনের প্রতি সজাগ হয়ে উঠার জন্য উদ্ভুদ্দ করে। এসব যুক্তির উদ্দেশ্য স্বতঃসিদ্ধ প্রমান পেশ করা নয় বরং কোরান এসব যুক্তির মধ্য দিয়ে এর শ্রোতাদেরকে দিব্য সম্ভবনাময় সত্ত্বা আকারে নিজেদের মেলে ধরতে প্রণোদিত করে। পরকালীন জীবনে দুঃখ কষ্ট ভোগ করা নিয়ে কোরানে যা উল্লেখ আছে তা একজন অবিশ্বাসীর কাছে কোনো অর্থবহতা রাখেনা বরং ইতিমধ্যে যারা কোরানের উপর বিশ্বাস এনেছে কেবল তাদের ইমানকে শানিত ও সচেতন করার তাগিদে বর্ণনা করা হয়েছে। কোরান মানবজাতির মধ্যে কেবল তাদের জন্য পথপ্রদর্শক যারা নিজেদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চায়। সুতরাং ইসলামী দাওয়াত যখন কাউকে যুক্তি ও চিন্তা দিয়ে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়, আমার বাবা বলছেন, তখন মুসলমানরা অবশ্যই পারস্পরিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে সব ধর্মের অনুসারিদের সাথে বসবাস করবে- লাকুম দ্বীনুকুম ওলিয়াদ্বীন (যার যার ধর্ম তার তার জন্য)।
ইতিহাসের এক বিশেষ মুহুর্তে আল্লাহ আখেরী নবীর মধ্য দিয়ে তার বার্তা প্রকাশ করেছেন, কিন্তু দুনিয়ার সবকিছুকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন না। কে কি বিশ্বাস করবে এবং কিভাবে করবে মানুষ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সে স্বাধীন। ‘’ আসলে আমরা এই দায়িত্ব ( চিন্তা ও এর তৎপরতা) নেয়ার জন্য আসমান জমিন ও পাহাড়কে প্রস্তাব করছিলাম, কিন্তু তারা অস্বীকার করেছে, কারন তারা ভয় পেয়েছিল। তথাপি মানুষ সে দায় কাঁধে নিয়েছে। আসলে মানুষ সবচেয়ে চতুর এবং বোকা।‘’ ( সুরা আল আহযাবঃ ৭২) । দৈবিক হস্তক্ষেপের ধারনা্কে, আমার বাবা দাবি করতেন, ঠিক ইসলামি ধারণা না। ইসলামে একটাই মাত্র দৈব বিস্ময় রয়েছে আর সেটা হলো কোরানুল কারীম। তাই তার কোরান থেকে আরেকটা প্রিয় বাণী ছিল, ‘’অবশ্যই আল্লাহ মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষন না তারা নিজেরা ভেতর থেকে বদলে যায়‘’ (সুরা আর রা’দঃ ১১)।
আমি বাবাকে প্রায় সময়ে দেখতাম তিনি তেলওয়াত করতেনঃ ‘’নিশ্চয়ই যারা ইমান এনেছে এবং ইহুদি, খ্রিস্টান ও সাবায়ীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও কেয়ামতের দিবসের উপর ইমান এনেছে অতঃপর সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান। তাদের কোন ভয় নাই এবং তারা বিচলিতও হবে না’’ ( সুরা আল বাকারাঃ ৬২)। তিনি বলতেন এসব আয়াতের মত এত স্পষ্ট আয়াত হিব্রু বাইবেল কিম্বা গসপেল কোনটাতেই কিছু উল্লেখ ছিল না। এসব আয়াত ইসলামের এই শিক্ষাকে তুলে ধরে যে, আহলে কিতাব বিশেষ করে ইহুদি এবং খ্রিস্টানেরা একেশ্বরবাদী ধর্মীয় ঐতিহ্যকে খুব ভালভাবেই ধারন করে যা ইসলামের মধ্যে দিয়ে মুলত চুড়ান্ত পরিণতি পায়। বাইবেল ও গসপেল প্রথম দিকের আসমানী কিতাম যা সময়ের পরিক্রমায় বিকৃত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব কিতাবে সত্য আছে বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এসব কিতাব মতবাদ হিসেবে ভুল হতে পারে কিন্তু একই ঐতিহ্যকে অনুসরন করা হয়েছে বিধায় আসমানি কিতাবের মর্যাদা দেয়া হয়। ইসলাম তার পুর্ববর্তী একেশ্বরবাদী ধর্মে বিশ্বাসীদের নিরন্তর উপস্থিতিকে কেলেঙ্কারি মনে করে না; ঠিক যেভাবে খ্রিস্টীয় ইতিহাসে ইহুদিদের উপস্থিতিকে কেলেঙ্কারি হিসেবে দেখা হয়। ইসলাম বরং এসব ধর্মে বিশ্বাসীরা ভুলভ্রান্তিকে একগুয়েমিতা নিয়ে কতটা সহজে আঁকড়ে ধরে রাখে সে ব্যপারে ইঙ্গিত করে। তিনি বলতেন, সত্যিকার ইসলামে বন্ধু ও শত্রুর মাঝে পার্থক্য নেই এবং দুনিয়ার মানুষকে ভালো ও খারাপ হিসেবে বর্গ করা কোন বাইনারি বিভাজনও ইসলামের ঐতিহ্যতে নাই। সুতরাং আমার বাবার কাছে এর মানে হলো ইসলামি ঐতিহ্য মুসলমানদেরকে অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের প্রতি শুধু সহনীয় হওয়ার আহবানই করে না বরং সবাইকে সমমর্যাদার অধিকারী হিসেবে বিবেচনা করতে উতসাহিত করে। তাছাড়া অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি সন্মান দেখানো মানে তাদের গভীর আশা ও প্রতিশ্রুতির বিষয়ে তারা যা বলতে চাইছে তা শোনার জন্য ধৈর্যশীল হওয়া। এই অর্থে কাউকে সন্মান করার মানে ছিল বন্ধুত্বের একই গন্ডির মধ্যে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা। যদিও ইসলামের ইতিহাসে সাধারণত একেশ্বরবাদী অথবা ইব্রাহিমি ধর্মের অনুসারিদের প্রতি সন্মানের কথা বলা হয়েছে তবে আমার বাবা জোর দিয়ে বলেছেন, সব ধর্মের বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের প্রতি সন্মান দেখানো উচিত । আমার বাবা স্বীকার করেছেন যে, কোরানে অন্য আয়াতও আছে যেখানে ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন এসব আয়াত রাসুলের জীবনে বিশেষ কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছিল। তাছাড়া এসব আয়াতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলো রাসুলের যুগে এমন বিশেষ গোষ্ঠী যাদের বিরুপ আচরনের কারনে বিশেষ পরিস্থিতিতে নবজাতক মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের মাঝে মিত্রতার সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমাদের সময়ে কিছু মুসলিম এই আয়াতসমুহের আমল করতে পারে; কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেছেন এসব আয়াত ইসলামের চিন্তার পরিসরে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে কোন মতবাদিক বক্তব্য ছিল না। যাইহোক, আসমানী সত্য এক বিশাল ঐতিহ্যকে ধারণ করে যার মধ্যে এসকল ধর্মের উত্থান ঘটেছে এবং শুধু মুসলিমদের উত্থান নয়। আল্লাহর কালামের বিকৃতি ও ভুল বুঝাবুঝি শুধু ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে পাওয়া যায় না বরং মুসলিমদের মধ্যেও আছে।
প্রসঙ্গক্রমে আমার বাবা প্রায়শ অভিযোগ করতেন যে, পশ্চিমারা ইসলামকে বিবেচনা করে আগ্রাসী, আক্রমানত্বক ও অসহিষ্ণু ধর্ম আকারে যা কিনা দুনিয়াতে আবির্ভুত হওয়ার পরবর্তী শতাব্দীজুড়ে বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তকরন ঘটিয়েছে। কিন্তু আসল সত্য হলো ইসলামের শুরুর দিকের শতাব্দীতে দুই একটি প্রান্তিক ঘটনা ছাড়া অবিশ্বাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা আসলে জোর প্রয়োগের ব্যপার ছিলো না। অমুসলিমদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয় এবং ক্ষমতা কাঠামোর সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত অনেক কিছু অনুদঘাটিত রয়ে গেছে অথচ এসব ব্যাপারে আলাপ করার সময় ব্যপক বাজে শব্দচয়ন করা হয় ( যেমন ভয় দেখিয়ে, বস্তুগত স্বার্থের লোভ ও ইসলাম ধর্মের সত্যের স্বীকৃতি আদায় করার মধ্যে দিয়ে নাকি অমুসলিমদের মুসলমান বানানো হইছে )। ধর্ম বদল বলতে এক ধর্ম থেকে পরিপুর্ণভাবে বাহির হয়ে অন্য ধর্মে প্রবেশ – এই অনুমান নিশ্চিতভাবে অতি সরলীকৃত আলাপ- যদি না ঐ বিষয়ের প্রেক্ষিতে এটার আইনি ভিত্তি থাকে। যাইহোক, জোরাবলির কারনেই ইসলামে অন্য ধর্মের লোকেরা ধর্মান্তরিত হয়েছে এই মিথ্যা দাবি পশ্চিমা বিশ্বে খুবই প্রচলিত আছে। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি উদাহরন হলো কয়েক বছর আগে রেজেনবার্গে পোপ বেনেডিক্ট এক অসাধারন বক্তৃতা দিয়েছেন। যেখানে তিনি দাবি করছেন, চিন্তা ও যুক্তি খ্রিস্টিয় ইতিহাসে সব সময় কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল অথচ এই চিন্তা ও যুক্তি ইসলামে নাই। যার কারনে ইসলাম জোর প্রয়োগ ও সহিংসতার উপর নির্ভরশীল ছিল।
যাইহোক, আমার বাবার কাছে, চিন্তা ও যুক্তির মুল বিষয়ে শুধুমাত্র অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের ব্যবহারের তরিকা এবং তাদের নিজ ধর্ম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা কেন্দ্রিক বস্তু ছিল না। বরং মুসলিমরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের যে কোন বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যকার অমিলসমুহ সুরাহা করার তরিকাটাই চিন্তাশীলযুক্তির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। তার মতে, চিন্তাভাবনায় গভীর অমিলের কারনে কখনো অন্য মুসলিমদেরকে অবিশ্বাসী (তাকফির) বলে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করা উচিত নয় । বরং এর পরিবর্তে তাদের উচিত একে অপরের সাথে বাহাস করা যেখানে ঐক্যমতে পৌঁছতে না পারলেও এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সন্মান করবে। এই প্রেক্ষিতে তিনি রাসুলের বানী উদ্ধৃত করেন ‘ইখতিলাফে উলামা উম্মতে রহমা’ (উলামাদের মাঝে মতানৈক্য উম্মতের জন্য রহমত)। তিনি নিজেও ইসলামের সঠিক ব্যাখা, মতবাদ ও চর্চা প্রসঙ্গে অন্য মুসলিমের সাথে খুব জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করতেন। কিন্তু তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ( তা’ আসুব, তাশাদ্দুদ ), ধর্মীয় বাড়াবাড়ি ( ঘুউলু ) এবং ধর্মীয় ফতোয়ার নামে অনৈতিক নিষ্ঠুরতাকে ঘৃণা করতেন- হোক তা কোন দাঙ্গা, কোন ব্যক্তি কিম্বা কোন রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত। এই প্রেক্ষিতে তিনি বলতেন কেউ যদি নিজেকে মুসলমান ঘোষণা করে তাহলে সে মুসলমান হয়ে যায়। তার ঐ ঘোষণার আন্তরিকতা একান্তই আল্লাহ ও তার মধ্যকার বিষয়; অন্যকারো তাতে নাক গলানোর এখতিয়ার নাই।
আমার বাবা সাধারণত ধর্মকে (এবং মুসলমান হিসেবে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে) কোনো একটা বিষয়ে নৈতিক ভুল ও সঠিকতা নির্ধারণ করার জন্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করতেন। ঠিক এই কারনেই তিনি একটি ইসলামি রাষ্ট্রের জরুরিয়াত ভেবেছেন। একদা তার লেখায় তিনি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেনঃ ‘’কোন জাতি বা সম্প্রদায় যতক্ষন পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে নিজেরা একজোট হতে না পারে ততক্ষন সুখ কি জিনিস তা মালুম করতে পারে না এবং কোন জাতি বা সম্প্রদায় প্রকৃতপক্ষে নিজেরা একজোট হতে পারে না যদিনা মানুষের ব্যাপারে কোনটা সঠিক কোনটা ভুল তা নিয়ে নিজেরা ঐক্যমতে পৌছায় এবং এই ধরনের ঐক্যমত্য সম্ভব হয়না যদিনা কোন জাতি বা সম্প্রদায় চিরস্থায়ী ও নির্ভেজাল নৈতিক বিধান থেকে নাজিল হওয়া হুকুমকে মেনে নেয়। অবশ্যই একমাত্র ধর্মই যা কোন একটি কওমের মধ্যে এই ধরনের ঐক্যমতের ভিত্তি ও বিধিবিধানের যোগান দেয় যেখানে ঐ কওমের সব সদস্য নৈতিক আধীনতার বাঁধনে আবদ্ধ থাকে।‘’ ( ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকারে নীতিমালা, ১৯৬১ পৃঃ ৬)। মজার বিষয় হচ্ছে, ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তার এই আলাপ, অতীতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নির্ভর নয় বরং চিন্তা ও যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। যাইহোক, চিন্তা ও যুক্তির দিয়ে যদি ইসলামিক রাষ্ট্রকে সমর্থন করা যায় তাহলে চিন্তা ও যুক্তি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে যা আমি আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
আমার বাবার কাছে নৈতিকতা ও আইন কার্যত অভিন্ন; বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য যাদেরকে আল্লাহর ইচ্ছার নিকট নিজেদের সমর্পন করে দেয়ার দরকার হয়। যদিও আমার বাবা স্বীকার করেছেন সব অনৈতিক কাজ বিচারযোগ্য নয় তবুও তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি রাষ্ট্র ধর্মীয় বুনিয়াদের উপর গড়ে তোলা যায় কারণ শুধু রাষ্ট্রই ক্ষমতাবলে আল্লাহর হুকুমকে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং আল্লাহর আইনই সত্যিকারের সব সুখ ও নীতিমালার উৎস। কিন্তু এখানে আমার প্রশ্ন, যদি একটি রাষ্ট্র মুসলমানদের নৈতিকতার জন্য জরুরী হয় তাহলে অমুসলিমদের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে নৈতিকভাবে বসবাস করা কি সম্ভব? যদি তারা রাষ্ট্রীয় আইনের নৈতিক শক্তির অধীনই না হয় তাহলে নাগরিক হিসেবে তাদের বিশ্বস্ততার মাপকাঠি কি হবে?
ইসলামি রাষ্ট্রের অনেক প্রবক্তাদের মতো আমার বাবাও মানতেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রে যদিও অমুসলিমদের পুর্ণ নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয় তবে তারা ইসলামি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যায়ের আসতে পারবে না। তিনি মনে করতেন, এটি আসলে অমুসলিমদের প্রতি অন্যায্য আচরণ নয় কারন এর বিপরীতে তাদের জন্য অন্যত্র বাড়তি ছাড় স্বীকার করা হয়েছে । যেমন ‘অমুসলিমদের রাষ্ট্রের প্রতি পরিপুর্ণ অনুগত হওয়ার দরকার নাই; যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্রের আদর্শ তাদের বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা থেকে পুরাই আলাদা। অন্য কথায়, যারা নেতৃত্ব এর পর্যায়ে আছে কেবল তাদের থেকেই রাষ্ট্র পুর্ণ আনুগত্য পাওয়ার দাবীদার এবং যারা রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে আছে তাদের সকলের আনুগত্যকে নিশ্চিত করার দাবী রাখে। যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের পক্ষে এই দ্বিগুন কাজ পুরাপুরি আদায় করা সম্ভব নয় তাই তাদের জন্য রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত না থাকার স্বীকৃতি ছিল। এর চেয়ে বেশী যুক্তিসম্মত আর কি হতে পারে?
আমার প্রতিক্রিয়ার শুরুতেই বলতে চাই সব নাগরিকদের কাছ থেকে অকাট্য আনুগত্য এবং ঐক্যের যে দাবি রাষ্ট্র করে তা সম্পুর্ণ আধুনিক দাবী। শত্রু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিদের মোকাবেলার জুজু দেখিয়ে সব নাগরিকদের একসাথে মিলিয়ে রাজনৈতিক ঐক্য গঠন এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য আদায় করাটাই জাতিরাষ্ট্রের নীতি। প্রাক আধুনিক রাষ্ট্র এসব দাবি করত না এবং প্রয়োজনও ছিল না। প্রাক আধুনিক রাজাদের কাছে গভর্নর, জেনারেল এবং গন্যমান্য ব্যক্তিদের আনুগত্যই কেবল প্রধান বিষয় ছিল। সাধারন প্রজাদের আনুগত্য অত ধর্তব্যের বিষয় ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক রাষ্ট্রের সরকারের তুলনায় প্রজাদের উপর তৎকালীন রাজাদের কার্যকরী ক্ষমতা ছিল অনেক কম। কারণ আগেরকার রাজাদের বিশাল সমাজ ও ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হিমশিম খাওয়া লাগতো। আর সেটি আধুনিক রাষ্ট্র বিশাল আমলাতন্ত্র, তথ্যযন্ত্র এবং প্রযুক্তিগত উপকরন ব্যবহার করে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আধুনিক রাষ্ট্র আগের শাসন কাঠামো থেকে স্বতন্ত্র হওয়ার পেছনে এসব আংশিক কারন বরং সাংবিধানিক ভিত্তিটাই আসল। আধুনিক রাষ্ট্র শাসক এবং শাসিতদের থেকে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান এবং এটির প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে প্রয়োজনে যেকোন মুল্যে নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখা। এর মৌলিক নীতিমালা বাস্তবধর্মী এবং দূরদর্শিতা কিন্তু নৈতিকতা নির্ভর নয়। ঠিক এই কারনে আধুনিক রাষ্ট্র (হোক সেকুলার কিম্বা ইসলামিক) তার ভৌগলিক সীমানার মধ্যে কোনো অঞ্চলকে সর্বময় কর্তৃত্বের স্বাধীনতা দেয়ার অনুমতি দিতে পারে না। তবে যদি ঐ অঞ্চলের স্বাধীনতার প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনের শর্তাধীন বিষয় হয় তবে সেটি ভিন্ন কথা। তারমানে রাষ্ট্র তখন এক নির্দিষ্ট উপায়ে তার নিজস্ব সার্বভৌমত্বকে সীমিত করার বিষয়ে একমত হয়। জনপরিসরে কর্তৃত্বমুলক আইন কানুন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে; তবে এই তর্ক বিতর্কের জন্য সরকার নয় বরং স্বয়ং রাষ্ট্র তাদেরকে অনুমোদন দেয়। ঠিক এই কারনে অতীতের কোন শাসন ব্যবস্থা ( এমনকি ইসলামের বিগত শাসন ব্যবস্থাও) এরকম কর্তৃত্ববাদী আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে মিলে না।
আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক যুক্তি হচ্ছে হচ্ছে আন্তঃ ও বহিঃশত্রুর ভয়ের কারণেই এটি আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। এইজন্য আধুনিক রাষ্ট্র এর ক্ষমতাকে নাগরিকদের ঐক্য গঠনের কাজে ব্যবহার করে। কোন ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আনুগত্য না দেখায় সেখানে রাষ্ট্র তাদের অসম্মতি ও সন্দেহকে পাত্তা না দিয়ে বলপ্রয়োগের মধ্যে দিয়ে আনুগত্য নিশ্চিত করবে। তখন দেখা যায় রাষ্ট্রের ভেতর থেকেই অন্যকোনো রাজনৈতিক সম্প্রদায় প্রকৃত ও সম্ভাব্য শত্রু আকারে দাঁড়িয়ে যায় এবং তখন যে কোনো রাষ্ট্রের মতো ঐ রাষ্ট্রও তার টিকে থাকাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। তবে লিবারেল রাষ্ট্র এই সাধারণ বাধ্যবাধকতার বিপরীতে ‘মানবিক আপত্তিকে’ আমলে নেয়। উদাহরণস্বরুপঃ একজন নাগরিক যিনি ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে সামরিক বাহিনীতে সেবা দেয়াকে অপছন্দ করেন, তিনি চাইলে আইনানুযায়ী এই বাধ্যবাধকতা থেকে সরে আসতে পারেন। লিবারেল রাষ্ট্র এটিকে অবাধ্যতা হিসেবে দেখেনা বরং ব্যক্তিগত অধিকারের চর্চা হিসেবে দেখে। যাইহোক, এতে করে ‘মানবিক আপত্তি’ ও ‘আইন অমান্যতার’ মাঝে পার্থক্য টানা হয় যেখানে কেবল ‘আইন অমান্যকেই’ জন শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
আধুনিক লিবারেল রাষ্ট্র এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা একইসাথে সাধারণ কিছু উপকারের পাশাপাশি নিষ্ঠূরতা ও জুলুমের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে কাজ করে । শাসক এবং জনগন রাষ্ট্র থেকে দূরে অবস্থান করে; শাসক আসে আর যায় কিন্তু রাষ্ট্র চিরায়মান থাকে। সরকার রাষ্ট্রের ঐক্য সাধনে দেখভাল করে এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করে। সরকার রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে রাজি করানোর পরিবর্তে বরং ‘জাতীর স্বার্থের’ নামে আইনকে ব্যবহার করে। এর একটা মানে হলো যারা আইন অমান্য করে তাদের শাস্তি দেয়া। অবশ্যই আইনকে নানান কায়দায় ব্যাখা করা যায়। কিন্তু এই আইন হচ্ছে রাষ্ট্রের বিচারিক হাতল যেখানে ব্যাখা মোতাবেক কর্তৃত্বমুলক সিদ্ধান্ত চুড়ান্তভাবে নেয়া হয় । আইন হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ব্যাখার ঘোষণা তাদের বৈধতার পক্ষে কয়েক ধরনের সহিংসতা ঘটায়। রাষ্ট্রের সহিংসতা চালানোর একক আধিপত্য এবং কেন্দ্রীভুত আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রকে এমন ক্ষমতা দেয়- যা নাগরিকরা এককভাবে জড়ো হয়ে যতটুক করতে পারে তার চেয়েও রাষ্ট্রকে বেশী শক্তিশালী করে তোলে। এটি সত্য যে লিবারেল সেকুলার রাষ্ট্র ভিন্ন মতাবলম্বীদের বাক স্বাধীনতা ও গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করে থাকে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রই আসলে এর অস্তিত্ত্বের জন্য হুমকি এমন কোন রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধকে সহ্য করে না।
আধুনিক রাষ্ট্রের উল্লেখিত বৈশিষ্টের আলোকে, কোন কোন মুসলিম মনে করে, রাষ্ট্রের প্রতি পরিপুর্ন আনুগত্য দেখানো (এবং আধুনিক রাষ্ট্রের দাবির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখানো) এক ও একমাত্র আল্লাহ প্রতি তাদের যে পরম আনুগত্য রয়েছে তার সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ফলে, আধুনিক রাষ্ট্রকে তারা যখন ‘সমাজের আসল মুর্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে তাতে তব্দা খাওয়ার কিছু নাই। (রাষ্ট্রের প্রতি এই মনোভাব একমাত্র কঠোর একেশ্বরবাদ অনুসরণ করার ফলে তৈরি হয়েছে এবং ‘নেগেটিভ পলিটিক্যাল থিওলজী’তেও এর প্রতিফলন দেখা যায়)। এমনকি ইমানের ঘোষণাতেও একমাত্র আল্লাহ ও তার রসুলের প্রতি নিঁখুত আনুগত্যের কথা নির্দেশ করা হয়। তাতে দুনিয়ার কোন শাসক কিংবা দুনিয়াবী কোন সংগঠনের প্রতি আনুগত্যের কথা উল্লেখ করা হয় না। ইসলামি রাষ্ট্র অবশ্যই নৈতিকতা সম্পন্ন রাজনৈতিক নিয়মকানুন নিয়ে আগ্রহী। যাইহোক কারো কাছে মনে হতে পারে ‘ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ’ নিয়ে কোরানের নির্দেশিত মতবাদ যৌক্তিকভাবে কোন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কথা বলে না। কোরানের এই মতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের চুড়ান্ত পরাকাষ্ঠার যুক্তিকে নাকচ করলেও রাষ্ট্রের কোন একটি প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে এই দায়িত্ব তুলে দেয়ার পক্ষেও নয় । অবশ্য, ধর্মে কোনো বাড়াবাড়ি নেই ( লা ইকরাহা ফি দ্বীন) এমন নির্দেশনা থাকা স্বত্ত্বেও, মুসলিম ইতিহাসে শাসকরা নিজেরাই ধর্মীয় ও নৈতিক আচরনকে ( কখনো কখনো অন্য সময়ের তুলনায় আরো কঠোরভাবে) নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব নিয়েছিলো। তবে বর্তমানে আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে জনসাধারনের আচার আচরনের উপর কর্তৃত্বমুলক আইন আরোপ করে ঐতিহাসিক মুসলিম রাষ্ট্র দ্বারা তা সেভাবে চর্চা করা হয়নি। ফকিহরা যারা (পেশাগতভাবে ও আর্থিকভাবে) সরকার থেকে স্বাধীন ছিল তারাই সেসব নিয়ন্ত্রন করত।

অন্য অনেক মুসলিমের মত আমার বাবাও সৃষ্টির সাথে স্রষ্টাকে এক করে মিলিয়ে দেখাকে ধর্মবিরুদ্ধ কাজ হিসেবে বিবেচনা করতেন। এদিকে আধুনিক রাষ্ট্র কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টিকুলের আরেকটি সৃষ্টি। তাই আমার কাছে মনে হয় আধুনিক রাষ্ট্রের চুড়ান্ত তাবেদারি করা যাবে না। অবশ্যই যারা ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকল্পকে সমর্থন করে তারা যুক্তি দেয় যদি শাসক নিজে ইসলামের নির্দেশনা মানে এবং তার প্রজাদের উপর তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে কেবল তখনি ইসলামি শাসকদের হুকুম মানা যাবে। এক্ষেত্রে তারা মধ্যযুগীয় ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে তাইমিয়ার ব্যাখাকে হাজির করে। তাইমিয়া মুসলিম শাসকদের আনুগত্য করার উপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেনঃ যদি শাসক ইসলামের হুকুম আহকামকে অনুসরন না করে তাহলে মুসলিম প্রজাদের দায়িত্ব শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এখন একটি আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় হুকুম আহকামের যথাযথ প্রয়োগ কে বা কারা নির্ধারন করবে তা নিয়ে স্পষ্টতই নানার প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এর সোজা জবাব হলোঃ আধুনিক রাষ্ট্র নিজেই তা করবে; এই কাজ হয় প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে করবে নতুবা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃত ও অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করবে। এই অর্থে আধুনিক রাষ্ট্র চুড়ান্ত সার্বভৌম রাষ্ট্র; যা প্রাক আধুনিক রাষ্ট্রগুলো কখনো ছিল না। অতএব আমার কাছে এই বিষয় পুরাপুরি পরিষ্কার নয় কেনো আমার বাবা ইসলামী রাষ্ট্রের –আদতে আধুনিক রাষ্ট্রের- অকাট্য আনুগত্যের দাবির পক্ষে সায় দিয়েছেন এবং মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করার সিঁড়ি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করেছেন।
কার্ল স্মিথের বিখ্যাত সার্বভৌমত্ত্বের তত্ত্ব এক রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের (পলিটিক্যাল থিওলজির) ব্যাখা হাজির করেছে। সার্বভৌম হচ্ছে জরুরী অবস্থায় আইনের তোয়াক্কা না করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। সার্বভৌমের এই ক্ষমতাকে তিনি প্রকৃতির নিয়ম কানুনের উপরে খোদার অলৌকিক হস্তক্ষেপের সাথে এক করে দেখছেন। সালাফি ঐতিহ্য মতে ধর্মের সেকুলারাইজড চিন্তা হাজির করে রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয়া যায় না। ইসলামী ঐতিহ্যে আল্লাহকে ঐশ্বরিক পিতা হিসেবে কল্পনা করে না (যেভাবে আধুনিক ইউরোপীয়ান ঐতিহ্যের শুরুর দিকে রাজাদের স্বর্গীয় ক্ষমতা চর্চার অধিকার আছে বলে মনে করা হতো)। এমনকি ইসলামে আল্লাহকে স্বর্গীয় চুক্তির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও ধারণা করে না (যেমন করে সামাজিক চুক্তির উপর ভিত্তি করে আধুনিক রাজনৈতিক বয়ান গড়ে উঠছে)। ইসলামে সার্বভৌম তত্ত্বের ধারণা নাই কারন ইসলাম মনে করে আধুনিক রাষ্ট্র এর নাগরিকদের থেকে অকাট্য আনুগত্যে দাবি করার অধিকার রাখে না।
আমি ইতিমধ্যে যা বলছি এর বিপরীতে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের দাবি হচ্ছে, একটি ইসলামি রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিকানা মানুষের নয় বরং আল্লাহর। তাদের সিদ্ধান্ত হলো এই চিন্তা থেকেই ইসলামিক রাষ্ট্রের নির্ভেজাল আনুগত্যের কথা এসেছে। কিন্তু কোরান যেখানে জোর দিয়ে বলেছে দুনিয়ার সবকিছুই আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্বের অধীন, সেখানে এটি আমার কাছে পরিষ্কার নয়, কিভাবে মানুষের বানানো রাষ্ট্র নাগরিকদের থেকে অকাট্য আনুগত্য দাবি করার বিশেষ অধিকার পায়? এটি সুস্পষ্ট কারণ আল্লাহ কর্তৃত্ব অন্য কারোর উপর অর্পন করা যায় না এবং ইসলামি রাষ্ট্রের কোন শাসকই তার নামে কথা বলতে পারে না। একমাত্র রাষ্ট্রই আঞ্জাম দিতে পারে এমন কতিপয় কাজের দরকারে বর্তমান বিশ্বে আমাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজন হতে পারে। ফলে এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের দাবি করতে পারে; যার মানে হলো এর নিজস্ব ভুখন্ড ও নাগরিকদের ছাড়াও অনান্য রাজনৈতিক সত্ত্বার উপর এটির একচ্ছত্র অধিকার ও ক্ষমতার চর্চা করবে। যাইহোক, ইসলামে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য কোন ধর্মতাত্ত্বিক স্বীকৃতি নাই ।
ইসলামি রাষ্ট্রের প্রবক্তারা বলেছেন, অমুসলিমরা যেই ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাস করে ঐ রাষ্ট্রের প্রতি পুর্নাঙ্গ আনুগত্য দেখাতে পারে না। আমি বলছিনা যে তারা পারে বরং এজাতীয় আনুগত্যের ধারণা আধুনিকতা থেকেই উদ্ভুত; নাগরিক কিংবা আইনি আদর্শ থেকে নয়।
ইসলামি রাষ্ট্রে এমন আর কি আছে যা অমুসলিমরা করতে পারে না? আমার বাবা জোর দিয়ে বলেছে ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে সব নাগরিকদের -এর মধ্যে অমুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত – জনপরিসরে ভিন্নমত পোষণ করার এবং প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করার আধিকার আছে। কিন্তু একটি ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকরা সরকারের কতটুক সমালোচনা করতে পারবে যেখানে জোরালোভাবে বলা হয়েছে এটি তাদের সরকার নয়? তারমানে আমি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠদের উস্কে দিয়ে সংখ্যালঘুদের ভয়ের কথা বলছিনা বরং আরো গুরুত্বের সাথে রাষ্ট্রেীয় পরিসরে তাদের পুরাপুরিভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকারের কথা বলছি যাতে সমালোচনা করা যায়। কারন সমালোচনার বৈধ পন্থা নির্ভর করে সমালোচনাকারী যে রাষ্ট্রে বসবাস করে ঐ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিসরে তার পরিপুর্ণভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উপর। আরো গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন আমি আগেই তুলেছিঃ মুসলমানদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য যদি রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্ব সত্যিই অপরিহার্য হয় তাহলে অমুসলিমরা নৈতিকতার সহিত এমন রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারেনা। কারণ ঐ নৈতিকতা তাদের নিজস্ব বিশ্বাস কিংবা ধর্ম থেকে উদ্ভুত নয়। অতএব যে কেউ যুক্তি দিতে পারে আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব নৈতিকতার চর্চায় বাধা দেয়।
আমি মনে করি যে, কেউ আমার বাবার ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষে যে বক্তব্য তাতে আরো অন্যকিছু খুজতে পারেন। এক্ষেত্রে আমি তাদেরকে ‘’রাজনৈতিক জীবনে ধর্ম ও নৈতিকতার জায়গা’কে’’ সিরিয়াসলি গুরুত্ব দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। সর্বপ্রথম আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য করা দরকার। রাষ্ট্র ক্ষমতা চর্চার মধ্য দিয়ে শাসন করে এবং নাগরিকদের থেকে আনুগত্যের দাবি করে ( যেখান থেকে রাষ্ট্রদ্রোহী আইনের উদ্ভব হয়) এবং ভয়ের জুজু দেখিয়ে শাসন করে – বিশেষ করে অভ্যন্তরীন ও বহিরাগত আক্রমনের ভয়। আইনানুগ শাস্তি ও যুদ্ধ হলো সার্বভৌম রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কাজ। থমাস হবস রাষ্ট্রের এই ধারনাকে খুব সমঝদারির সহিত বিখ্যাত করে তুলেছেন এবং পশ্চিমা ঐতিহ্যে হবসের এই তত্ত্বকে আধুনিক রাষ্ট্রের একবারে গোড়ার চিন্তা হিসেবে ভজনা করা হয়। অপরদিকে রাজনীতি মুলত তর্কবিতর্ক, লড়াই ও সাম্য ও সমতার দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করে। যে কেউ আমার মতের সাথে দ্বিমত করা কিংবা তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করা মানে তিনি আমার সমান। রাজনীতি রাষ্ট্র ক্ষমতা কেন্দ্রিক মনোনিবেশ হতে পারে কিন্তু তা হওয়ার দরকার নাই। কারণ শুধুমাত্র সার্বভৌমত্বই দাবি করে রাষ্ট্র হবে সব কিছুর কেন্দ্র এবং রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য।
উদারবাদী রাজনৈতিক তত্ত্বের ( লিবারেল পলিটিক্যাল থিওরীর ) সাম্প্রতিক সংস্করনে পাবলিক ও প্রাইভেট পরিসরকে স্পষ্টভাবে আলাদা করে দেখা হয়েছে ( এমনকি যেসবক্ষেত্রে আদতে আলাদা নয় সেখানেও আলাদা করা হয়েছে ) ঠিক যেমন আইনকে পরিস্কারভাবে নৈতিকতা থেকে পৃথক করা হয়েছে (এমনকি বাস্তব জীবনে যদিও আইন ও নৈতিকতা একে অপরের সাথে সংযুক্ত)। তদনুসারে রাজনীতিকে সেকুলার রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও গঠিত নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয় এবং ধর্মকে দেখা হয় অনেকগুলো ডোমেইনের একটি যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মুল্যবোধ কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে হাজির থাকে। ধর্ম ও নৈতিক মুল্যবোধকে রাষ্ট্র থেকে ছাটাই করে দেয়া হয় কারন তা বিভিন্ন দলের মাঝে মতবাদিক দ্বন্দ সংঘাত বাড়িয়ে তোলে যা কখনো যৌক্তিভাবে মিটমাট করা যায় না এবং যা একটা সময়ে অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়। অতএব উদারবাদী তত্ত্বে ( লিবারেল থিওরীতে ) ধর্ম ও নৈতিক মুল্যবোধকে ব্যক্তিগত পরিসরে পাঠিয়ে দেয় যেখানে ব্যক্তি তার খেয়ালখুশিমত তাদের ধর্মীয় ফতোয়া ও নৈতিক সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালিত হবে। যাইহোক, সেকুলার রাষ্ট্র শান্তির নিশ্চিত করে অপরদিকে রাজনীতিতে ধর্ম ঢুকে যুদ্ধ ও বেসামরিক অরাজকতা বাড়িয়ে তোলে – যারা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে আমি ঐসব চিন্তকদের সাথে একমত।
এতদস্বত্ত্বেও, নৈতিকতা ও ধর্মকে কিভাবে জনজীবনে বিশদভাবে নিয়ে আসা যায় সে প্রশ্ন আমার বাবার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল। নৈতিকতার প্রতি ঝোকটাই তার ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনার মুলে ছিল। আমি মনে করি এই বিষয়ে তিনি ভুল পথে এগিয়েছিলেন। আমার মতে তিনি আধুনিক রাষ্ট্র ও মধ্যযুগের শাসনকে জুদা করেন নাই। এমনকি রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন নাই। যদি তিনি এই পার্থক্যটি করতেন তাহলে ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণার প্রচার নিয়ে কম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে পারতেন এবং তথাকথিত পাকিস্তান নামক ইসলামি রাষ্ট্র যেটির সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলেন তা নিয়ে পরে কম হতাশ হতেন। তিনি দেখতে পেতেন আধুনিক রাষ্ট্র (হোক সেটি সেকুলার কিম্বা ইসলামিক) স্বভাবগতভাবেই ক্ষমতা চর্চার রাষ্ট্র। আজকাল নাগরিকদের অনেক উপকার হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন হতে পারে, যা মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থায় গরহাজির। তবে এটিও ঠিক যে, আধুনিক রাষ্ট্র অনেক নির্মমতা, জুলুম ও তান্ডব লীলার উৎস।
অমুসলিমদের নিরাপত্তা দেয়া এবং তাদের বিশ্বাস ও কথা বলার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পাশাপাশি বিবেচিত মাত্রায় স্বায়ত্বশাসনের অনুমতি দেয়া ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে পারে। কিন্তু সব অমুসলিমদের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও এটি তাদের পুর্ণ রাজনৈতিক অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করেনা; যেমনঃ রাষ্ট্রীয় পরিসরে পুরাপুরি অংশ নেয়ার অধিকার তাদের নাই। এর একটি বাস্তব পরিণতি হলো রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যালঘুদের মাঝে পার্থক্যের রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ করা। এভাবে পার্থক্য করাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পরিচয় ও আকাঙ্খার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। আমার সোজা কথা হলো যদি রাষ্ট্রই তাদের না হয় তাহলে অমুসলিম নাগরিকরা যে আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করে –ঐ রাষ্ট্র সত্যিকারার্থে তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। ঠিক যেমন ইজরাইলে বসবাসরত অইহুদি নাগরিকরা (হোক তারা মুসলিম কিম্বা খ্রিস্টান) তাদেরকে ইহুদি রাষ্ট্রটি বর্জন করে এবং এর ফলে তারা রাষ্ট্রীয় পরিসরে ঢুকতে পারেনা।
অতএব, আমার কাছে মনে হচ্ছে মুসলিমদের জন্য রাজনৈতিক ইসলামের সম্ভাবনা কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা এবং এর মাধ্যমে খোদার অনুমোদিত আইন প্রয়োগ করার মধ্যে নাই । বরং এর সম্ভবনা সুন্দর কথাবার্তা ও যুক্তি দিয়ে মানুষকে অনুপ্রানিত করার মধ্যে এবং এক গভীর ধর্মীয় প্রতিশ্রুতির দ্বারা পরিচালিত লড়াইয়ের মধ্যে নিহিত; যে প্রতিশ্রুতিসমুহে জাতি রাষ্ট্রের মতোই সুবিধা অসুবিধা উভয় দিক আছে। রাজনীতি এই অর্থে দলীয় রাজনীতি নয়; এটি সুগঠিত আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে পুর্ব প্রতিষ্ঠিত পক্ষপাতমূলক স্বার্থের মধ্যেকার দ্বন্ধও নয় বরং এটি মুল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় যা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে আবিষ্কার (পুনঃ আবষ্কার ) এবং গঠন ( ও সংস্কারের ) বিশেষ চলমান প্রক্রিয়া। এটি আধুনিক রাষ্ট্রের মোকাবেলায় সাহস ও ঝুঁকি নেয়ার তৎপরতা ধারণ করে যা আধুনিক রাষ্ট্র (দলীয় রাজনীতি) সহ্য করতে পারে না। এই রাজনীতি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দমনমুলক আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বিরোধীতা করে লিবারেল রাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে পারে; এমনকি সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করতে পারে।
আমার বাবার নৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে এর সম্পর্ক-যা আমার কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে- তা দিয়ে আলোচনা শেষ করবো।
তিনি আমার সামনে বারেবার সুরা তাকাসুর ভীষণ দরদ নিয়ে তেলাওয়াত করতেনঃ ‘’আল হাকু মুততাকাসুর, হাত্তা জুরতুম আল মাকাবির‘’ (অধিক সম্পদ লাভের প্রতিযোগিতা তোমাদের গাফেল করে রেখেছে, এমনি করে তোমরা ধীরে ধীরে কবরের কাছে গিয়ে হাজির হবে। সুরাঃ আত তাকাসুর ১-২)। তিনি বলতেন, এসব আয়াতে অপরিমিত ভোগ আর লোভ লালসাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছে। যেসবের মোহে বিশেষ করে আমাদের সময়কার মানুষ আজকাল আঁটকে পড়ে আছে । ইলম আল ইয়াকিন (সত্য জ্ঞান) এবং লা তারা উন্নাল জাহিম (অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম দেখবে) আয়াতদ্বয় নিছক আখেরাতের জীবনের শাস্তি নিয়ে নয় বরং দুনিয়ায় যে প্রকৃত জাহান্নামের মধ্যে আমরা বসবাস করছি তা নিয়ে সতর্ক করেছে। আমার বাবা এসব আয়াত তেলওয়াত করে বলতেন, যে ক্ষতি আমরা আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের করছি যদি আমরা স্পষ্টত এই সত্য দেখতে পারতাম তাহলে আমাদের সামষ্টিক জীবনের নারকীয় দিকগুলো উপলদ্ধি করতাম। এটিই তার নৈতিক চিন্তার মুল জায়গা ছিল এবং এখান থেকে ইসলামি রাজনীতি শুরু হতে পারে । মুসলিমদেরকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, সামষ্টিক জীবনের অংশ হিসেবে লোভ লালসা (তথা অধিক জিনিসের প্রতি অতৃপ্ত বাসনা) এবং অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রদর্শনী একইসাথে মানুষকে আল্লাহর চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কুমন্ত্রনা দেয় এবং আমাদের জীবনযাপনের বৈষায়িক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া থেকে দূরে রাখে। যেমনঃ সমাজের সামরিকীকরন, ধনী ও গরীবের মধ্যে অসমতার প্রসার , প্রাকৃতিক পরিবেশের অবিরাম ধবংশ, আবহাওয়া ও পারমানবিক বিপর্যয়ের মত মহামারির ঘটনা ।
আমাদের এখন জীবনযাপনের প্রধান পুর্বশর্ত হচ্ছে বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রের অধীনে নির্ভরশীল হওয়া। ঐ রাষ্ট্র শুধুমাত্র অকাট্য আনুগত্যের দাবি ই করে না বরং ভোগবাদিতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রচার প্রসার ও নিয়ন্ত্রন করে। অথচ তা সব সময়ের জন্য সুখকর নয় । অন্যভাবে বললে সেকুলার লিবারেল রাষ্ট্র স্ববিরোধী মুল্যবোধের দিকে উৎসাহিত করে। একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয় ( বিশেষ করে সভা সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় এবং ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করে ) আরেকদিকে ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে সামষ্টিক স্বাধীনতাকে হেফাজত করা হয়। অথচ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সামষ্টিক নিরাপত্তার কোনটাই বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, যা জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্ন করে, তার মোকাবেলার জন্য কোনো প্রতিরোধমুলক হাতিয়ার নয়। এই রাষ্ট্র নব্য-উদারবাদী অর্থনীতি ( নিও লিবারেল ইকোনমিকে ) জারি রাখে (যার পরিণতিতে সমাজ জুড়ে বাজার অর্থনীতির বেপরোয়া প্রসার, সম্পদের ব্যক্তিগতকরন, মুনাফার অসম বন্টন এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল বিশ্বে মুনাফার জন্য উদাম লালসার জোয়ার বইতে থাকে)। একটি ইসলামিক রাজনীতি বিদ্যমান ব্যবস্থার বাহিরে নতুন কিছুর খোঁজ করতে পারে, এমনকি এর বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারে, তবে প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোকে বিশেষ ধর্মীয় আদর্শের জুব্বা লাগিয়ে প্রতিস্থাপন করা ইসলামিক রাজনীতির উদ্দেশ্য নয়। রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমানার মধ্যে অথবা এর বাহিরে যেসব নন ইসলামিক আন্দোলন ও ঐতিহ্যের মধ্যে একইরকম নৈতিক বুঝাপড়া আছে তাদের সাথে ইসলামী রাজনীতির মৈত্রী গঠন করা দরকার। এই রাজনীতি স্মিথিয়ান অর্থে বন্ধু বনাম শত্রুর মোকাবেলার রাজনীতি নয় বরং এটি লিবারেল রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়িত জনপরিসরে ধামাচাপা থাকা বিষয়গুলো তুলে আনার এক প্রচেষ্টা।
জনসাধারনের মাঝে পুন্যতাকে উৎসাহিত করার এবং জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লড়াই অবশ্যই বস্তুগত সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তোলার জন্য অতিরিক্ত লালসার বিরুদ্ধে লড়াই; যে বস্তুগত সম্পত্তির মোহে একজন আরেকজনের সহায় সম্পত্তিতে লোভে লোভাতুর হয়ে তার বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকার জন্য নিজেও সম্পদ বানাতে থাকে। ভয় হলো, লোভের অন্ধকার দিক; কিন্তু লোভ শুধু অপরিমিত লালসাই নয় বরং এটি জগতের এক আত্মপ্রবৃত্তির অসুস্থতাকে নির্দেশ করে । এর বিপরীতে আছে রাজনৈতিক লড়াই যা মৃত্যু ও ক্ষয় ক্ষতির ভয়কে পরোয়া করে না। এই রাজনীতি লিবারেল রাষ্ট্রের সেকুলার নিরপেক্ষতার দাবিকে আগ্রাহ্য করে। এই অর্থে রাজনীতি লিবারেল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ত্বের বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে বরং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌলিক মুল্যবোধকে প্রসারিত এবং রক্ষা করার ইচ্ছে থেকেই উদ্ভুত হয়। নৈতিক ও ধর্মীয় জেহাদ হিসেবে রাজনীতিই একমাত্র নিরস্ত্র লড়াই -যে লড়াই মৃতুর ভয় কে পরোয়া করে না আবার তা নিছক মৃত্যুর জন্য লড়াইও নয় -যা মুসলিম-অমুসলিম, জীবজন্তু ও মানবাজতির সাধারণ জীবনের বিহব্বলতার জন্য উদ্বেগ উৎকন্ঠা বজায় রাখতে পারে এবং বস্তুগত সম্পত্তি ও সামরিক ক্ষমতার লোভ থেকে সৃষ্ট সমকালীন বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে পারে।
কারো কারো মত অনুযায়ী ইসলামী রাজনীতির দুটো দিক আছেঃ প্রথমত, এই রাজনীতি নিয়ে আলাপকারীদেরকে তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনাচরণকে পরিবর্তন করে নৈতিকভাবে আরো ভালোর দিকে ধাবিত করার আহ্বান জানানো, হোক সেটা ব্যক্তিগত পরিসরে কিংবা জনপরিসরে। রাজনৈতিক দাওয়াত শ্রোতাদের বিশেষ সংবেদনশীলতাকে আগ থেকেই বুঝতে পারে। তারপর তাদের সামনে দাওয়াত পেশকারী তার নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পাশাপাশি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যতটুক কাজ করছে তা হাজির করে । এখানে সংবেদনশীলতা ও চারিত্রিক গুণাবলি এক সাথে জড়িত। ইসলামি রাজনীতি সেটি তার নিজস্ব স্বতন্ত্র উপায়ে অনুশীলন করতে পারে। এই রাজনীতি শুরু হবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস তথা ইমান থেকে । তাছাড়া মানুষের মাঝে ভিন্নতা হল পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপুর্ণ সম্পর্ক নির্মানের আহবান- এই ঘোষনা দিয়ে। তারপর এই রাজনীতি জাতীয় ভৌগলিক সীমানার ভেতরে ও বাহিরে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে বন্ধুত্ব ও নাগরিক সম্পর্ক প্রতিস্থাপনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হবে। মানুষে মানুষে জাতপাত বর্ণের ভিন্নতা এবং তাদের জীবন যাপনের বৈচিত্রকে কোরান জগতের স্থায়ী বিধান এবং অপরিহার্য হিসেবে দেখে। আমার বাবা প্রায়শ তেলাওয়াত করতেনঃ ” হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি ৷ তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার…”( হুজরাতঃ ১৩)। এটি শুধু জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় (আসলে কোরানে রাষ্ট্র নিয়ে কোথাও উল্লেখ নাই) বরং মানবজাতির সব ধরনের বৈচিত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আরেকটি দিক হচ্ছেঃ এই রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্ভর নয় ( অর্থাৎ নির্বাচনী বিজয় চাওয়া দলগুলোর রাজনীতির মত নয়) বরং প্রতিরোধমুলক ( মানে রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী)। এই রাজনীতি নিছক ক্ষমতার জন্য লড়াই অর্থে ‘রাজনৈতিক’ নয়; এমনকি উম্মাহর ঐক্য সাধনের জন্য কারো আকুতি হাজির করার প্রচেষ্টা অর্থেও নয়। এটি মার্ক্সীয় শ্রেণি সংগ্রাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত অর্থে রাজনৈতিক নয় কিংবা ক্লজউইজের মত অনুযায়ী নাগরিক সমাজে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়া অর্থেও নয়। এটি এই কারণে রাজনৈতিক যে, এই রাজনীতি সাধারণ বিষয়গুলোতে সম্মিলিতভাবে মনোযোগ দেয়ার দাবি তুলে। এই রাজনীতি রাষ্ট্রের একচেটিয়া খবরদারির জবাবে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি প্রকাশ্যে অবাধ্যতার চর্চা করে এবং রাষ্ট্রের নিঁখুত আনুগত্য করাকে প্রত্যাখান করে কারণ তা শেরেক ( যেহেতু আল্লাহর কর্তৃত্বের সাথে কোন কিছুর শরীক করা কবিরা গুনাহ)। এই রাজনীতিকে ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের’ সম্মিলিত চর্চা হিসেবে গন্য করা যায়। এই সম্মিলিত চর্চা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা ‘রাষ্ট্রীয় চেতনায় ঐকবদ্ধ’ হওয়া ছাড়াই পালন করা যায়। এই রাজনীতির উদ্দেশ্য বিশ্বের উন্নয়ন করা নয় বরং দুনিয়ার ক্ষুদ্র এক অংশকে স্বল্প এক সময়ে মধ্যে সংশোধন করা। বিদ্যমান বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এবং আধিপত্য বিস্তারের যুগে; এই রাজনীতি শুধু সার্বভৌম রাষ্ট্রকেই নয় বরং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে, যা রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করার কাজ করে, তাদেরকেও মোকাবেলা করে। ‘জাতীয় ঐক্যের’ চেতনা সংজ্ঞানুসারে স্বতন্ত্র অথচ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অর্থে এটি বিভ্রান্তিকর চেতনা। কারণ এই চেতনার ধোয়া তুলে রাষ্ট্র নিজ স্বার্থে এর নাগরিকদের জীবন বিসর্জন দেওয়ার দাবি করে। এই চেতনাকে ইসলামি রাজনীতি বিপজ্জনক মনে করে। ফলে এই আপদকে জনসাধারনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং বন্ধুত্ত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোকাবেলা করা যেতে পারে। অবশ্যই অমুসলিমরাও ( এক্ষেত্রে সবধরনের ধার্মিক ও নাস্তিক ব্যক্তিরা ) রাষ্ট্রের নানান আইন কানুন ও নীতিমালার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে। কিন্তু বেশীরভাগ সেকুলারদের কাছে এই লড়াই সাধারণত ব্যক্তিগত নৈতিক বিবেকবোধের সাথে সম্পর্কিত। এটিকে তারা কোন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যক্তির নৈতিক পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করে।
আমার কাছে মনে হয়, ইসলামি প্রতিরোধমুলক রাজনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে ‘ব্যক্তির বিবেককে চুড়ান্ত’ বলে গন্য করার প্রয়োজন নাই (কারন ব্যক্তির ধারণা ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে অবিরাম নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়) বরং এই রাজনীতির উৎস হবে ইমানি চেতনা নির্ভর যা (১) সময়ের সাথে সাথে আবাদ হয় (২) ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে এর কর্তৃত্ব সাজানো হয় এবং (৩) পরিবেশ, অর্থনীতি এবং মানবীয় সম্পর্কের পণ্যায়নের বিরুদ্ধে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামে যুক্ত থাকে। জগতের প্রাণ ও প্রকৃতি আল্লাহর দান। সুতরাং, এর ধবংশের বিরদ্ধে নিরন্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম মুলত ‘শুকুর আল মুনীম’ ( তথা পরম অনুগ্রহকারীর প্রতি অশেষ শুকরিয়া আদায় করা) থেকে উদ্ভুত। এর মানে হল মানবজাতির প্রতি আল্লাহর অফুরান দানশীলতার জন্য তার শুকরিয়া আদায় করা যেটিকে কোরান আল্লাহর বিস্ময়কর নেয়ামত (তথা আয়াত) বলে বারবার উল্লেখ করছে। শুকর আল মুনীম ধারণাটির মাঝে কেউ হয়তো জাদুমুগদ্ধতার (এনচান্টমেন্টের) দিকে আহবানের গন্ধ পেতে পারে। যদিও আরবীতে জাদুমুগদ্ধতা ( এনচান্টমেন্টের) অনুবাদ হিসেব ‘ছেহর’ শব্দটি প্রচলিত, তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রেক্ষপটে মুসলিমরা কখনো তা ব্যবহার করে না। আমি এখানে ওয়েবারীয়ান-পরবর্তী ( পোস্ট ওয়েবারীয়ান) চিন্তার আলোকে এর ব্যবহারের সমস্যা নিয়ে সংক্ষেপে আলাপ করছিঃ মুসলমানদের বিশ্বাস হলো জগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। এই জগতে যত বিস্ময়কর বস্তুরাজি ও ঘটনা ঘটেছে সব আল্লাহর কারিশমায় হয়েছে। ওয়েবারিয়ান চিন্তানুযায়ী জগত নিয়ে এই ধরনের ধ্যান ধারণাকে জাদুময়তা তথা এনচান্টমেন্ট বলা হয় এবং তা মোকাবেলা করার জন্য যুক্তি নির্ভর হতে বলে। এই বিবেচনায়, এনচান্টমেনট যুক্তির ক্ষেত্রে কেবল প্রতিবন্ধকই নয় বরং আধুনিক হওয়ার শর্তই হলো এনচান্টমেনটকে ( যেটাকে ধর্মীয় ধ্যান ধারণা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ) বর্জন করা। এভাবে একটি বিশেষ উপায়ে জগতের সাথে সংযুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস যে কাউকে অভ্যাসগত উদাসীনতার বাহিরে পরিবর্তিত উপলদ্ধির মধ্যে দিয়ে বিস্ময়কর চেতনার দিকে বিমোহিত করে। অবশ্যই ধর্মীয় বিশ্বাস ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে ( ভুল ধারণা সৃষ্টির উৎসও অনেক আছে) তবে ভুল ধারণার গোড়া কেটে দিতে গিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলাটার ক্ষতি অনেক। এটি একটি বিশেষ ক্ষতির জন্ম দেয়।
আমার কাছে স্পষ্টত মনে হচ্ছে ইসলামি রাজনীতির এই ধারণা যে কাউকে ইসলামি রাষ্ট্র বানানোর আধুনিক ধান্ধা থেকে দূরে রাখবে। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা বিদ্যমান যেকোন আধুনিক রাষ্ট্র থেকে আলাদা নয়। আমি বিশ্বাস করি আমার বাবার জীবন ও লেখায় এই চিন্তা অন্তর্নিহিত রয়েছে এবং এটি তার চিন্তাধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অবশেষে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, তিনি এমন কোনো নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যিনি ইউরোপকে ধারণ করতেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছে বরং তিনি ইসলামের সমৃদ্ধ চিন্তা ও তৎপরতার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ধারণ করতেন। যে ঐতিহ্য (অন্য ঐতিহ্যের মতই) চিন্তার বৈচিত্রকে ধারণ করে। অন্য সকল আমলদার মুসলমানের মত তিনিও ইসলামী ঐতিহ্যের বাহিরে অবস্থান করেন না বরং এর মধ্যেই আছেন এবং তাদেরকে পছন্দ করতেন। তার জীবন ও চিন্তায় যে ভিন্ন অবস্থান পরিলক্ষিত হয় সেসব ইসলামের ঐতিহ্যের মধ্যেকার চিন্তা হিসেবে গ্রহন করা যায়। আজ পশ্চিমের এমন অনেক লোক যারা ইসলামের একক অসহিষ্ণুতা ঘোষণা করে। তাদের এই ঘোষনা ঠিক এই কারনে ভুল নয় যে ইসলাম সত্যিকারার্থে সহিষ্ণু বরং তাদের এই ঘোষণা ভুল এই কারনে যে, ইসলাম সম্পর্কে – অথবা ঐ বিষয়ে অন্য কোন ধর্ম সম্পর্কে- কথা বলার ক্ষেত্রে তা কোন চিন্তার উদ্রেক করে না; যদি না তাতে কেউ কোন অর্থপুর্ন আলাপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ধর্মীয় বনাম অধর্মীয় ঐতিহ্যের স্বভাব নিয়ে কথা বলা এক রাজনৈতিক বয়ানের অংশ; যা গ্রহণ ও বর্জনের সাথে সম্পর্কিত। এটি চিন্তা ও যুক্তির নিরপেক্ষ চর্চা নয়।
আমি অনুরোধ করব ‘ইসলাম বনাম পাশ্চাত্যের মধ্যে আলাপ আলোচনা ( ডায়ালগ ) যেটি হাল আমলে ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে তারচেয়ে আমার বাবার জীবনকে উপরোক্ত আলোচনা সাপেক্ষে দেখা অধিক গুরুত্বপুর্ণ। তথাকথিত সভ্যতাসমুহের সংলাপ (ডায়ালগ অব সিভিলাইজেশানস) আসলে দুই ধরনের আনুমানিক সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ( ১) মুসলিমদের ইউরোপীও এবং উত্তর আমেরিকানদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা উচিত যে ইসলাম সহিংসতার উৎস নয়। একইসাথে (২) পশ্চিমাদের উচিত ইসলামের সংস্কার সাধনে সহযোগিতা করা। এটি আসলে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে রেখে অপরের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার মত ধারণা। এটি কি হতে পারে যে সংলাপের সাম্প্রতিক আহবান অন্য সভ্যতা ও সমাজের সাথে সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছে থেকে নয় বরং অভিবাসীদের আক্রমনের ভয় থেকে উদ্ধুদ্ধ হয়েছে? অবশ্যই মুসলিমদের অন্য সমাজ ও ঐতিহ্যের প্রতি মনকে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত এবং তাদের থেকে ক্রিটিক্যালি কিছু শিখা ও নেয়ার মন মানসিকতা থাকা উচিত; ঠিক যেভাবে কেউ আশা করে যে পশ্চিমারাও ইসলামি চিন্তা ও অভিজ্ঞতা থেকে শিখবে ( এমনকি যদিও তাদের অধিকাংশই তা করতে চায় না)। যাইহোক, আমি মনে করি, ধর্মীয় মতাদর্শের চেয়ে বৈশ্বিক শক্তির কারণে পরস্পরকে বোঝাপড়ার এজাতীয় শিক্ষা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। যারা সংস্কারের কথা বলে তাদের এটি মনের মধ্যে গেঁথে রাখা দরকার যে ইসলামের ইতিহাসে সংস্কার খোদ ইসলাম ধর্মের মতই বহু পুরোনো বিষয়। ফলত, বর্তমান সময়ে ইসলামের সংস্কার অবশ্যই স্বচ্ছ ও সজীব চিন্তার ভিত্তিতে হতে হবে। তবে আমার মত হচ্ছে, এই সংস্কারের কার্যকরিতা আসলে একই সময়ে পশ্চিমারা নিজেদের কীভাবে সংস্কার করছে তার উপর আংশিকভাবে নির্ভরশীল। কারন আমরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত দুনিয়াতে বসবাস করি।
বইপাতিঃ
১। ইসলাম এট দ্যা ক্রসরোড (সংশোধিত সংস্করণ, জিব্রাল্টারঃ দ্বার আল আন্দালুস, ১৯৮২)।
২। সহীহ আল বুখারীঃ দ্যা আর্লি ইয়ার্স অব ইসলাম (জিব্রালটারঃ দ্বার আল আন্দালুস ১৯৮১, নতুন সংস্করণঃ কুয়ালালামপুরঃ ইসলামিক বুক ট্রাস্ট, ২০০২)।
৩। আরাফাতঃ এ মানথলি ক্রিটিক অব মুসলিম থট (ডালহৌসি,১৯৪৬-১৯৪৭)।
৪। প্রিন্সিপল অব স্টেট এন্ড গভর্মেন্ট ইন ইসলাম (বার্কলেঃ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৬১; সংশোধিত সংস্করণ। জিব্রাল্টারঃ দ্বার আল আন্দালুস, ১৯৮০)।
৫।দ্যা মেসেজ অব দ্যা কোরান (জিব্রাল্টারঃ দ্বার আল আন্দালুস,১৯৮০। নতুন সংস্করণ,ইউনাইটেড কিংগডমঃ দ্যা বুক ফাউন্ডেশান, ২০০৩)।