রক্তাক্ত ইন্দো-বাংলা সীমান্ত: নগ্ন জীবনের মুক্তির দিশা

January 7, 2025

তামিম মুনতাসির

গবেষক

মজলুম জনতার ইতিহাস হতে আমরা শিখেছি যে, যে জরুরী অবস্থা’র মধ্যে আমরা বসবাস করছি তা ব্যতিক্রম নয় বরং স্বাভাবিক অবস্থা। আমাদের ইতিহাসের এমন ধারণায় আমাদের উপনীত হতে হবে যা মজলুমের ইতিহাসের সাথে খাপ খায়। তখন আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পারব যে একটা  “আসল জরুরী অবস্থা” আনয়ন করাই আমাদের কাজ এবং তখনই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের অবস্থার উন্নতি ঘটবে। 

 

~ ওয়াল্টার বেনিয়ামিন।  

ফেলানী হত্যার ১৪ বছর পূর্ণ হলো আজ। কাঁটাতারের সীমান্তে ঝুলে থাকা ফেলানী খাতুনের লাশ আসলে নিছক একটি খুনের চিত্র নয় বরং ভারতের আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সামনে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বাস্তব চিত্র। মানবাধিকার সংস্থা “অধিকার” এর তথ্য অনুসারে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ কতৃক বাংলাদেশের নাগরিক খুন হয়েছে ৫৮৮ জন এবং আহত হয়েছে ৭৭৩ জন। ১৪ বছর হয়ে গেল ইতোমধ্যে, ফেলানী হত্যা মামলা আজও ঝুলে আছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। এই মামলার প্রতি ভারতীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর বিচারিক প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করলে এটি ধরে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, ফেলানী হত্যার বিচার হবে না। ফেলানীর মামলার ক্ষেত্রে সীমান্ত হত্যায় বিচারহীনতার আলামত কোন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতির চলমান ধারাবাহিকতা। প্রতিনিয়ত নির্বিচারে সীমান্ত হত্যা স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয় বরং একটি জরুরী অবস্থা। কিন্ত, এই জরুরী অবস্থা আমাদের কাছে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা দেয় না। জরুরী অবস্থা চর্চার মধ্যে দিয়ে একটা ধরনের ঐতিহ্য বা প্রথায় উপনিত করা হয় ( Hurd,1999)। ভারত সীমান্ত হত্যাকান্ডের মতো “জরুরী অবস্থা” কে স্বাভাবিক অবস্থায় পরিনত করেছে। এই স্বাভাবিক অবস্থার ভ্রম থেকে বের হয়ে যখন একটি “আসল জরুরী অবস্থায়” উপনীত হতে পারব, তখন ফেলানীদের আর অকাতরে জীবন দিতে হবে না। ভারত রাষ্ট্র কতৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে নিহত একেকটি জীবন হয়ে আছে হোমো স্যাকের বা নগ্ন জীবন। 

রোমান আইনের ইতিহাসের বিভিন্ন বিবরণীতে পাওয়া যায়, হোমো স্যাকের হলো এমন একধরনের মানুষ যাকে উৎসর্গ করা যাবে না, কিন্ত যে কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে। অর্থাৎ হোমো স্যাকের হত্যা যেমনিভাবে ত্যাগ, পরিশুদ্ধি এবং ক্ষমার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হবে না ঠিক তেমনি, তাকে হত্যা করা অপরাধ হিসেবেও গন্য হবে না। হোমো স্যাকের প্রাচীন রোমের সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং আইনী পরিভাষা যার আক্ষরিক অর্থ হয় – পবিত্র মানুষ। রোমান লেখক ম্যাক্রোবিয়াস লিখেছেন – যদিও আর সব পবিত্র কিছুর অমর্যাদা করা নিষিদ্ধ কিন্ত পবিত্র মানুষকে (হোমো স্যাকের) হত্যা করা বৈধ। আক্ষরিক অর্থে হোমো স্যাকের অর্থ পবিত্র মানুষ হলেও তা ঠিক পবিত্র নয়, বরং অভিশপ্ত। সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে বহিষ্কৃত একজন অপরাধীর জীবন হোমো স্যাকেরের জীবন। হোমো স্যাকেরের সাথে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের সম্পর্ক হলো হোমো স্যাকের একটি আইনবহির্ভূত জীবন, কিন্ত আইন বিচ্ছিন্ন নয়। আইন তাকে অপর করে না, অন্তভূক্ত করে বহির্ভূত হিসেবে। আর সার্বভৌম হলেন ঐ সত্তা যিনি জরুরি অবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সার্বভৌম সত্তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে; আইন কখন কার্যকর থাকবে আর কখন থাকবে না। অর্থাৎ, সার্বভৌম ক্ষমতা আইন নিয়ে খেলা করে। বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করা ভারতের শাসক শ্রেণির কাছে খেলাধুলায় পরিনত হয়েছে। ভারতের শাসক শ্রেণির কাছে বাংলাদেশের নাগরিকরা হোমো স্যাকের বা নগ্ন জীবন। 

মানবাধিকার সংস্থা “অধিকার” এর অভিযোগ অনুয়ায়ী, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় জমিজমায় চাষাবাদ করার সময় নিরীহ চাষাভুষারা বিভিন্ন সময় হত্যার শিকার হয়েছে। বিভিন্ন কৃষকের তথ্যানুসারে, তারা যখন সীমান্তের পাশে তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে যায়, তখন বিএসএফ তাদের হাতের নিশানা পরীক্ষা করার জন্য গুলি চালায়। এখানে খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাব, ভারতের শাসক শ্রেণির কাছে বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদা খেলাধূলার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়। একটি যু্দ্ধ পরিস্থিতি বিহীন অবস্থায় বাংলাদেশের নাগরিকের জীবন শুধুই একটি ট্রেনিং’র নিশানা। দার্শনিক জর্জো আগামবেনের মতে, সার্বভৌম ইচ্ছার বলি হিসেবে কিছু মানুষের নাগরিকত্ব অথবা রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়াটা অধুনিক জাতি রাষ্ট্রের একটি চিরায়ত বৈশিষ্ট্য, যদিও একটি দেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের নামেই অধিকাংশ জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ নামে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল একাত্তরের ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। কিন্ত বাংলাদেশ আদৌ রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হতে পেরেছে কিনা তা এখনো বিতর্কের বিষয়। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কখনোই ভারত কতৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের রক্তের দাম ভারতের কাছ থেকে নিতে পারেনি বরং বাংলাদেশ ভারতের কাছে নিজের নাগরিককে হোমো স্যাকের হিসেবেই উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র  হিসেবে কোন ধরনের রাজনৈতিক অভিমূখ জনগনের প্রতি কায়েম হলে প্বার্শবর্তী দেশ কীভাবে সীমান্তে নির্বিচারে হত্যা করে তা ভাবার জরুরত রয়েছে। একজন মানুষের যদি রাজনৈতিক অধিকার না থাকে তার জীবন নগ্ন জীবনে পরিনত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, এটিও আমাদের বলে রাখা উচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের হোমো স্যাকের গন্ডি থেকে বের করে মানবিক মর্যাদার আনার প্রচেষ্টা করার ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেনি। সে জায়গা থেকে ফেলানীর হোমো স্যাকেরে পরিবর্তন হওয়ার পেছনের ভারতে আগ্রাসন তো দায়ী রয়েছেই সাথে বাংলাদেশের সচ্ছতা ও সদিচ্ছাও দায়ী।

অধিকন্তু, ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশ সম্পর্কে যে বয়ান তার সাথে জর্জ বুশের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের বয়ান কিংবা ইসরায়েলের ফিলিস্তিন গুড়িয়ে দেয়ার বয়ান অথবা পুতিনের ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপের বয়ানের সাথে কোন পার্থক্য নেই। দিল্লীর মসনদে আসীন মোদীর অভিমূখ খুবই পরিষ্কার; বুশ যদি পারে, পুতিন যদি পারে, নেতানিয়াহু যদি পারে তিনি কেন পারবেন না। তথাকথিত নিরাপত্তা অথবা সন্ত্রাসবাদের বয়ানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে। এর একটি প্রমাণ ২০০৫ সালের ১৯ জুলাই তারিখে সীমান্ত হত্যা সংক্রান্ত ভারতীয় হাই কমিশনের বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, বাংলাদেশের নাগরিকদের অসামাজিক এবং অপরাধী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 

“It should be noted that about 80 percent of the incident and causalities have taken place at night when criminals and anti- social elements involved in arms narcotics smuggling, smuggling in contraband goods and those involved in transborder crimes such as dacoity, cattle lifting etc, have tried to cross the border under the cover of darkness.”

কিন্ত হতাশার বিষয় হচ্ছে এই, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের কাছে আজ অবধি কী পরিমাণ আর্মস, নেশাজাত দ্রব্য বিএসএফ উদ্ধার করতে পেরেছে তার কোন পরিসংখ্যান তারা দেখাতে পারেনি। এমনকি তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপর সশস্ত্র সহিংসতায় নিয়োজিত ছিল তারও প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। মোদ্দাকথা হলো যে, ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে বিচারবহির্ভূত হত্যা সন্ত্রাসবাদের বয়ানের মাধ্যমে জায়েজ করে, আর বাংলাদেশের দৃষ্টিতে ভারতকে “বন্ধু রাষ্ট্র” হিসেবে আখ্যায়িত করার বয়ান হাজির থাকে। এই নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব যে আমরা কতটুকু রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পেরেছি। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা বিশ্বায়নের যুগে পুঁজির আগ্রাসনেরই প্রসারিত রুপ। বিশ্বায়নের দুনিয়ায় পুঁজির বিচরণ কোনো অসুবিধা না থাকলেও মেক্সিকো আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে ঠিকই মানুষের বিচরণ ঠেকাতে কাঁটাতারের দেয়াল গড়ে তোলা হচ্ছে। কাঁটাতারের দেয়ালে ঝুলে থাকে ফেলানীর জীবন। ঝুলে থাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব। আধুনিক ও উত্তর আধুনিক দুনিয়ার উন্নত বিশ্বের বামপন্থী দার্শনিকদের পক্ষে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটানোর রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া যত সহজ ; আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের পক্ষে অতটা নয়। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ঔপনিবেশিক, সম্রাজ্যবাদী, ও বর্ণবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমরা রাষ্ট্র বানিয়েছি। এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার দিশা আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

দৃশ্যতঃ কতিপয় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অস্তিত্ব বিদ্যমান হওয়া সত্বেও বিভিন্ন ফ্রন্টিয়ারে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ার নজির কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্ষমতার উপর সরাসরি প্রশ্ন তোলে; একই সাথে এটি হতাশা ও লজ্জাজনক বিষয়। ‘বন্ধুত্ব’ নামক ধোঁয়াশামূলক শব্দবন্ধের দোহাই দিয়ে ইতোমধ্যেই অসংখ্য অসম চুক্তি সম্পাদিত করে নিয়েছে ভারত। অথচ যখন রাষ্ট্র গঠিত হয়, তার ধারণার মূলেই থাকে অন্য রাষ্ট্রকে কৌশলগত ও স্বার্থগত ‘অপর’ কল্পনা করা। রাষ্ট্র মানেই হচ্ছে তার শত্রু থাকবে প্রকৃতিগতভাবেই; নিদেনপক্ষে প্রতিদ্বন্ধী। ন্যায়ই হবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলভিত্তি। সেখানে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ভারত অসম চুক্তিসমূহ সম্পাদন করে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হয়ে ওঠার মৌলিক ধারণায় উত্তীর্ণ করেনা। ভারতের সঙ্গে  সম্পাদিত সকল চুক্তিসমূহকে পুনঃবিচার করা এখন সময়ের দাবী। একটিকে যুতসই উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার জরুরত তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার জন্য সবার আগে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে হবে। যেখানে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘতম ভারতীয় সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত, চরিত্র বিচারে যেখানে ভারত একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র, সেখানে বাংলাদেশের জন্য টিকে থাকার লড়াইকে সচেতনভাবে জোরদার না করলে অচিরেই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। জাতীয় দৈনিকে উঠে আসা তথ্যমতে গত পাঁচ আগস্ট ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে অদ্য পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্তে ১১ জন মানুষকে বিএসএফ কর্তৃক হত্যা করা হয়েছে এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। 

বর্তমানে উপমহাদেশ একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটের সফরে আছে। আঞ্চলিক দাদাগীরি করার খায়েশ লালনকারী ভারত রাষ্ট্র বহু আগেই পুঁজিতান্ত্রিক নীতি অবলম্বন করার মাধ্যমে নিজেকে নিপীড়িত মানুষের সরাসরি প্রতিদ্বন্ধী বানিয়েছে। তার সাম্রাজ্যবাদী নীতির চলমান ধারায় হিন্দুত্ববাদী গোঁড়া কম্যুনাল রাজনীতি একটি নতুন প্রলেপ। মোদী-শাহের রাজত্বকালে ভারতে বসবাসকারী জনতা তাদের মৌলিক অধিকার হারিয়েছে। প্রসঙ্গত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ইসলামকে চরম মাত্রায় ‘অপর’ করে দেয়ার রাজনীতির উপরই টিকে আছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেখানে তার মূলেই ইসলামকে ‘’অপর’ জ্ঞান করে সেখানে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় রাজনীতির এই মোড় পশ্চিমা সমর্থন ইতোমধ্যেই যুগিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাই দেখা যায় আগ্রাসী ইসরায়েল অতি সহজেই ভারতকে নিজের ঘরানার হিসেবেই কল্পনা করে। নানানমুখী উদ্দেশ্য ও তৎপরতার ভিতর দিয়ে উপমহাদেশে অবস্থানরত মানুষদের উপর স্বভাবতই ভারত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ পরিচালনা করে যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ভারতে অবস্থানরত নানান বর্গের জনতা, বাদ যাচ্ছেনা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও। সর্বশক্তি দিয়ে সে চড়াও হচ্ছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উপরে। যেখানে তার রয়েছে অর্থনৈতিক ফায়দা, সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ বাস্তবায়ন ও ইসলাম প্রশ্ন। ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গন্ডিতে এর মোকাবিলা করার জন্য সকল প্রেজুডিস একান্তে রেখে নির্মোহ ভাবনাচিন্তা ও তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেয়া কিংবা ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিজমকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার পুরানো বস্তাপচা সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে সুরক্ষার কবচে আবৃত করার প্রচেষ্টায় সচেতনভাবে জনগণকে অংশগ্রহণ করতে হবে। ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ববাদী মোদী-শাহের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসীনীতিকে সম্মুখ বোঝাপড়ার মাধ্যমে অবিলম্বে আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মিত্র রাষ্ট্রের মিষ্টি কথায় ভুললে চলবেনা আমাদের। ভারতের অভ্যন্তরীণ মজলুম জনতার সাথে সংহতি প্রকাশ করতে হবে; তাদের লড়াইয়ে আমাদের এবং আমাদের লড়াইয়ে তাদের শামিল করার মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের জনতাই আমাদের আসল মিত্র, আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন সাম্রাজ্যবাদী ভারত রাষ্ট্রের শাসকবর্গ নয়। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষের পরিচয়কে সংকীর্ণ করে দিয়ে অপরায়নের রাজনীতি করার মাধ্যমে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয় যা মানুষকে শাসন করার ও আওয়াজকে দমানোর নব্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ লঘু হয়ে যাওয়ার শর্ত তৈরি হয়। বর্তমানে ভারতের অভ্যন্তরে তাই চলছে। ভারত সরকারের ক্রমাগত সীমান্তহত্যা ও তাদের অভ্যন্তরীণ মানুষের অধিকার হরনের নৈমিত্তিক ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের মানুষকে হোমো স্যাকের জ্ঞান করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ভারত সরকার জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। অতএব, ভারতের মজলুম মানবতার লড়াই আর আমাদের লড়াই এক। এহেন মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জলের মতো স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে ছাড়তে হবে। তবেই কৌশলগতভাবে আমরা এগিয়ে আসবো। যদিও এটি ফলপ্রসূ হবেনা কোনো অর্থেই, যদি না বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশীজনকে জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে আপোষহীনভাবে এগিয়ে আসা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কোনো ধরনের ধর্মান্ধতা বা ধর্মবিদ্বেষ দিয়ে এই রাজনৈতিক আগ্রাসনকে মোকাবিলা করা যাবেনা। তাই রাষ্ট্রকে সুসংহত করতে হবে ঐক্যের মাধ্যমে। অতঃপর রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও স্ট্রাটেজিক অধ্যয়নকে শক্তিশালী করতে হবে। 

পরিশেষে, পুঁজির গোলকায়নের বাড়ন্ত দৌরাত্ম্যে যেখানে মানুষের জীবন ক্রমাগত তুচ্ছতর হয়ে যাচ্ছে, মুক্তির উপায় হিসেবে মজলুম মানুষের রাজনৈতিক লড়াই একমাত্র পথ হিসেবে হাজির হয়। উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ভুভাগে বসবাসরত জনতাকে নিজেদের জান-মাল ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে হবে। অতএব মুক্তির পথে অন্তরায় সকল সংকীর্ণ মতবাদকে পুনঃবিবেচনা করতে হবে। হোক সেটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক কিংবা সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় গন্ডি। উপমহাদেশের মানুষকে নিজেদের ইতিহাসের সকল অনুমিত ও বাধিত আয়নাকে ছিন্ন করে নতুনভাবে মজলুম মানুষের ইতিহাস রচনা করা এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের সহীহ সংগ্রাম চিহ্নিত করতে হবে। বঞ্চিত মানুষের আসল শত্রুটিকে চিহ্নিত করতে না দেয়াই যেখানে শোষকশ্রেণীর রাজনীতি। সেখানে ইতিহাসের নতুন পাঠ ও জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যকার বোঝাপোড়ার মাধ্যমে শোষকদের রাজনীতির জাল ছিন্ন করতে হবে। তবেই সীমান্ত হত্যার মতো ন্যাক্কারজনক মানবতাবিরোধী অবিচ্ছিন্ন আগ্রাসনকে রুখে দেয়ার রাস্তা তৈরি হবে।