রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রূপান্তর- প্রারম্ভিক পাঠ

April 17, 2025

অনুবাদক: মোঃ আবরার হোসাইন

মানব ইতিহাসে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ বহুস্তরীয় ও বহুমুখী। এটি সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ধাপ ও পদ্ধতিতে বিকশিত হয়েছে। সভ্যতাগত রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রূপান্তর, রাষ্ট্রতর্ক আলোচনায় একটি নতুন ধারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের এই সভ্যতাগত রূপান্তর এবং এর উপাদান নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। এই লক্ষ্যে ‘জেং ওয়েইওয়েই’ (ZHANG WEIWEI) এর লেখা বিখ্যাত ‘দ্য চায়না ওয়েভ: রাইজ অব অ্যা সিভিলাইজেশনাল স্টেট’ ( THE CHINA WAVE: RISE OF A CIVILIZATIONAL STATE)- এর প্রারম্ভিক আলোচনা অনুবাদ করেছেন মোঃ আবরার হোসাইন।

পশ্চিমা বিশ্বে চীনের উত্থান নিয়ে নানান ধরনের বয়ান প্রচলিত আছে। গত ৩০ বছর ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যমে চীনা রাষ্ট্রকাঠামোকে দুটি বিপরীতমুখী চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। একবার বলা হচ্ছে, এটি একটি দমন-পীড়নমূলক শাসন ব্যবস্থা যা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চায়; আবার বলা হচ্ছে, এটি একটি প্রো-ডেমোক্রেটিক বিদ্রোহীদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্রোহী সমাজ। এমনকি ইউরোপের কিছু অংশে, যেমন অসলোতে (Oslo), তারা বিশ্বাসও করে যে বৃহত্তর পূর্ব জার্মানি এবং বেলারুশের মত চীনও একটি রঙিন বিপ্লবের (Color Revolution) অপেক্ষায়  আছে।

এ ধারণের চিন্তাভাবনা থেকে পশ্চিমা চিনা-বিশ্লেষকরা চীন সম্পর্কে নানা নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যেমন ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন (Tiananmen) ঘটনার পর শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে; সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো চীনও বিভক্ত হয়ে যাবে; দেং শিয়াওপিংয়ের (Deng Xiaoping) মৃত্যুর পর চীনে অরাজকতা দেখা দিবে; চীনের অধীনে যাওয়া মাত্রই হংকংয়ের সমৃদ্ধি হ্রাস পাবে; সার্স (SARS) মহামারি হবে চীনের চেরনোবিল(Chernobyl); ডব্লিউটিওতে (WTO) প্রবেশের পর চীন ভেঙে পড়বে; ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু চীন এই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত করে চীনের নয়, বরং চীনের পতন সম্পর্কিত সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীরই পতন ঘটিয়েছে। চীনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই হতাশাজনক পূর্বাভাসের রেকর্ড আমাদের এই বিশাল এবং জটিল দেশটির দিকে আরও বস্তুনিষ্ঠদৃষ্টিতে তাকানোর প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের উচিত হবে চীন বিশ্লেষণে জার্মান দার্শনিক জি. ডব্লিউ. লাইবনিজ (G. W. Leibniz) দ্বারা গৃহীত পদ্ধতিটি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা, যেখানে তিনি  দেখিয়েছেন চায়না কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় “প্রাকৃতিক ধর্ম” (Natural Religion) অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক শাসনকার্যে নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক দর্শনের ধর্মনিরপেক্ষ প্রয়োগ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা যদি কেবল আমাদের আদর্শগত সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত  হতে পারি, আমরা দেখবো যে গত তিন দশকে চীনে যা ঘটেছে তা সম্ভবত মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপ্লব; চীন ৪০০ মিলিয়নেরও অধিক মানুষকে দারিদ্র মুক্ত করেছে।

কিন্তু মজার বিষয় হলো, চীন যেখানে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত কোনো মডেল অনুসরণ না করেই এতো দ্রুত নিজেদের অর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সেখানে নিজ দেশেরই অনেক জনগণকে সে খুশি করতে পারছেনা। তবে পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বায়াত গ্রহণকারী কিছু মুরিদ এখনও বিশ্বাস করে যে, চীন যদি অতিসত্বর পশ্চিমা মডেল অনুসরণ না করে, তবে আজ বা কাল তারা ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হবেই হবে। এসব পশ্চিমা মুরিদ ব্যতিরেকে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখে এমন যেকোনো ব্যক্তিই চীনের এই উত্থানকে অস্বীকার করতে পারবে না। চীনের উন্নয়ন মডেল নিখুঁত নয়, এ কথা যেমন সত্য, তেমনই একথাও সত্য যে, যেসব উন্নয়নশীল বা অগ্রগতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামো পশ্চিমা মডেল অনুসরণ করেছে, তাদের তুলনায় চীনের সামগ্রিক সাফল্য এক কথায় অতুলনীয়। চীনের তথাকথিত এই ‘গায়েবি কামিয়াবি’ এখনো বিশ্বের নিকট যেন এক আশ্চর্য!

সূত্রঃ timstokesart

চীনের এই উন্নয়ন মডেলটি এমন একটি পরিস্থিতে গড়ে উঠেছে যখন বিশ্ব এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এবং অস্থির প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত। ফলে এটি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সাথে সহনশীল এবং খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো একটি উৎকৃষ্ট মডেল হিসেবে গড়ে উঠেছে।  এছাড়া দিন কেদিন নতুন নতুন বিশ্লেষণ এবং সংযুক্তির মাধ্যমে এটি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। লেখকের মতে তাই দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, চীনের উত্থান কোনো সাধারণ রাষ্ট্রের উত্থান নয়; বরং চীন একটি সভ্যতাগত রাষ্ট্র (Civilizational State) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমন উত্থান মানব ইতিহাসে অভূতপূর্ব। যদি মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু এবং গ্রিসের প্রাচীন সভ্যতাগুলো বর্তমান পর্যন্ত টিকে থাকত এবং আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হতো, তাহলে হয়ত তারাও এখন সভ্যতাগত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতো। কিন্তু সেই সুযোগ তো আর নেই। যদি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য এখন পর্যন্ত অখণ্ড থাকত এবং আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতো, তাহলে ইউরোপও একটি মাঝারি আকারের সভ্যতাগত রাষ্ট্র গঠন করতে পারত। কিন্তু এমন চিন্তাও বর্তমানে শুধুই অনুমান। একইভাবে, বর্তমান মুসলিম বিশ্ব যদি এক হয়ে একটি আধুকিন ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারত, তাহলে তারা একশ কোটির বেশি জনশক্তি সমৃদ্ধ একটি সভ্যতাগত রাষ্ট্র গঠন করতে পারত। কিন্তু তাও কখনো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে আজকের দিনে, একমাত্র চীনই এমন একটি দেশ, যা বিশ্বের প্রাচীনতম এবং দীর্ঘতম সভ্যতাকে একটি বিশাল আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে একীভূত করতে পেরেছে এবং তাদের সভ্যতাগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

একটি সভ্যতাগত রাষ্ট্র গভীরভাবে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবং সহজেই অন্য কোনো মডেলের অনুকরণ করে না, তা হোক পশ্চিমা বা অন্য যেকোনো। সে বরং তার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ত নীতি ও গতিতে বিকাশ হয়। তবে এতে যেমন কোন সন্দেহ নেই যে ভবিষ্যতে এটি নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে, এতেও কোন সন্দেহ নেই যে এর উত্থান এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য এবং শাশ্বত। এই ধরনের রাষ্ট্র কাঠামোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভাবিত বিশেষ শক্তিমত্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করে ঠিকই, কিন্তু কখনো নিজের স্বকীয়তাকে বর্জন করে না, বরং আঁকড়ে ধরে বহন করে চলে। ফলে সভ্যতাগত রাষ্ট্র একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো যা নিজেই নিজের মূল্যবোধ এবং মানদণ্ড নির্ধারণ করতে সক্ষম। একটি সভ্যতাগত রাষ্ট্র স্বাধীনভাবেই বিকশিত হতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে, এর জন্য অন্য কারও স্বীকৃতি বা অনুমোদনের প্রয়োজনের হয়না। এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেলও অনেক দিক থেকেই অন্যদের থেকে আলাদা। তবে এর মানে এই না যে এমন বিশেষত্ব হঠাৎ করে গড়ে উঠেছে; অতীতেও এটি এমনই ছিল, আজও তাই রয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও এমনই থাকবে। চীনা ভাষার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের জন্য যেমন ইংরেজি ভাষার অনুমোদন দরকার নেই, সান জুর আর্ট আব ওয়ার (The Art of War) কালজয়ী হওয়ার জন্য যেমন ক্লজউইৎজের (Carl von Clausewitz) স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই, কিংবা কনফুসিয়াসের দর্শন প্লেটোর দ্বারা স্বীকৃত না হলেও যেমন তার মূল্য কমে না, তেমনি চীনের বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। বরং যেটা অধিক বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে তা হলো, এক সময় চীনা ভাষা ইংরেজি ভাষার বিবর্তনে ছাপ ফেলবে; সান জুর আর্ট আব ওয়ার (The Art of War) পশ্চিমা সামরিক কৌশল নির্ধারণ ও বিকাশে প্রভাব বিস্তার করবে; কনফুসিয়াস ও প্লেটোর দর্শন মানবজাতির জন্য যুগে যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা দিয়ে যাবে, এবং চীনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেগুলোর জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ  দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

১৮তম ও ১৯তম শতকে বিশ্ব দরবারে যে দেশগুলো উত্থান ঘটিয়েছিল, যেমন ব্রিটেন ও ফ্রান্স, তাদের জনসংখ্যা ছিল কেবল কয়েক কোটি। ২০তম শতকে উত্থান ঘটা যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো দেশগুলোর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ কোটি। কিন্তু ২১তম শতকে চীনের উত্থান সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করেছে, যার জনসংখ্যা একশ কোটিরও বেশি, এবং যা পূর্বের দুই ধাপের দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যার চেয়েও অধিক। কিন্তু এটি কেবল সংখ্যার বিশালতার ব্যাপার নয়; এটি এমন একটি ‘অদ্বিতীয় রাষ্ট্রের’(sui generis) উত্থান যা প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে একটি নতুন উন্নয়ন মডেল তৈরি করে, এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন রাজনৈতিক বয়ানের সূচনা করার মাধ্যমে বিশ্ব পরিকাঠামোর নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।

বিশ্ব এখন এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছে, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য উল্লম্ব (vertical) ব্যবস্থা থেকে অনুভূমিক (horizontal) ব্যবস্থার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। একসময় যেখানে পশ্চিমা বিশ্বই ছিল শক্তি, সম্পদ ও চিন্তাচর্চার একমাত্র কেন্দ্র, সেখানে এখন এক নতুন বাস্তবতা গড়ে উঠছে, চীন এখন শক্তি, সম্পদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে পশ্চিমের সমকক্ষ হয়ে উঠছে। মানব ইতিহাসে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার এমন অভূতপূর্ব পালাবদল আগে কখনো দেখা যায়নি, এমন পরিবর্তন নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যবস্থার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেবে।