১
পাঁচ আগস্ট তথা ছত্রিশে জুলাই শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে যে হত্যাযজ্ঞ তিনি চালিয়ে গেছেন, তার ক্ষত এখনো দগদগে। এই ক্ষত বা ট্রমার শিকার কেবল জুলাইয়ের শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোই হয় নাই। পুরো বাংলাদেশের জনসমাজই মানসিকভাবে এই ক্ষত বা ট্রমা বয়ে চলেছে, যার নানানরকম প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। জুলাইয়ের ক্ষতের কিছু আনক্যানি প্রকাশের সাক্ষীও আমরা হয়েছি। যেমন, আগস্ট মাসে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ে যে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুলিশের হাতে নিহত বহু মানুষকে গণকবর দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ১২৭ জনের গণকবর শনাক্ত হওয়ার খবরও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের এই খবরটি পরবর্তী কয়েক মাসে বিভিন্ন সময় ফিরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবরটির সত্যতা যাচাই করা যায় নাই।
রায়েরবাজার এলাকার নামটি একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক ক্ষত বহন করে। শাহাদাতের ক্ষত হলো বাংলাদেশের জনগণের যৌথ চেতনার মধ্যে সদা জীবন্ত একটি ক্ষত। জুলাই মাসে বাংলাদেশের আপামর জনগণের অস্তিত্ব যখন গণহত্যার সম্ভাবনার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল, তখন একাত্তর তাদের অভিজ্ঞতার ঘরে বারবার হানা দিয়েছে। ইতিহাসের কর্তার ভূমিকা পালন করা জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ইতিহাসের দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ওয়াক্তকে আঁকড়ে ধরেছিল তাদের স্লোগানে ও গানে। আর শাহাদাতের যে ঐতিহাসিক ট্রমা আমরা জাতিগতভাবে বহন করে চলেছি, তারই সবচাইতে আনক্যানি একটা রূপ হয়ত ছিল রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নতুন গণকবরের খবরটি। আনক্যানি মানে যাকে চেনা মনে হয়, কিন্তু আবার অচেনাও বটে, যা ভূত এবং বর্তমান। আনক্যানি মানে ক্ষতের ফেরত আসা, নতুন কোন রূপে। কারণেই সে অচেনা – কিন্তু আবার চিরচেনা।
“যুগ বদলায়। শহীদি অমর রহে” – সম্প্রতি লিখেছেন তাহমীদাল জামী। কিন্তু শহীদী কীভাবে অমর রহে? শহীদ টাইটেলটির যে রাজনৈতিক ও ডিসকার্সিভ রূপ ও ব্যবহার, তা মোটেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন নয়। কে শহীদ, আর কে নয়, তা দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম তর্ক ও দ্বন্দ্বের বিষয় হয়ে আছে। শহীদি অমর থাকার মানে তবে কী? সকল মতাদর্শিক, দলীয়, এবং বয়ানগত পর্দা ছিড়ে ফেললে আমরা দেখবো যে একটি সহজ সত্য হলো – আমাদের ইতিহাসে বারবার জনগণের শাহাদাত ও কুরবানির পাটাতনে রাষ্ট্রের ইমারত নির্মিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সুবিচার নিশ্চিত করতে পারে নাই। রাষ্ট্রের জমিনে দাঁড়িয়ে যদি বলি, হয়ত, ন্যায় বিচার করা এবং ক্ষত উপশম করা একই বিষয়। রাষ্ট্র মেরামতও এর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কিন্তু শাহাদাত, যা মূলগতভাবে সাক্ষী হওয়ার, তথা প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা, তাকেতো কথার মধ্যে, বাক্য-ভাষার মধ্যে কখনো পুরোপুরি ধারণ অথবা প্রকাশ করা যায় না। দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের সংবিধান বা কোন রাজনৈতিক দলের বয়ান বা স্লোগানেও তাকে সংকুচিত করা যায় না। আজকের দিনে, ভিডিও প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আমরা আবু সাইদ ও মুগ্ধদের শাহাদাতের সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু আমরা কী আসলেই তাদের শাহাদাতের সাক্ষ্য হতে পেরেছি? শহীদরাতো চলে গেছেন। আমরা তাদের শাহাদাতের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারি বটে। কিন্তু তারা যে শাহাদাতের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, আমাদের পক্ষে কি তার সাক্ষী হওয়া কোনোভাবে সম্ভব? একটুও কি সম্ভব? আর যদি সম্ভব হয়, তবে কীভাবে?
নো ওয়ান বেয়ারস উইটনেস টু দা উইটনেস – পাউল সেলানের লেখা এই পঙক্তির মধ্যে সত্যতা আছে। যে শহীদ চলে গেছেন, তিনি যে সত্যের সাক্ষী হয়েছেন, আমাদের চোখের সামনে থাকা পর্দার কারণে সেই সত্য আমরা দেখি না, একদা লিখেছিলেন বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী। বড় পিরের ধর্মতাত্ত্বিক এই বক্তব্যেরই যেন একধরণের আধুনিক সংস্করণ আমরা পাই সেলানের কবিতায়। এর একধরণের সেকুলার (পলিটিকাল-থিওলজিকাল) সংস্করণ আমরা হয়তো পাই জর্জো আগাবমেনের রেমনেন্টস অফ আউসউইটজ নামক কিতাবেও। তিনিও লিখেছেন, যে শহীদ ডুবে গেছেন (মারা গেছেন), তিনিতো কথা বলেন না। তবে, আগামবেন আবার এই দাবিও করেন যে, কবিতার মধ্যে অনেক সময় সাক্ষ্য থেকে যায়। এবং সেইসাথে তিনি মৃত শহীদ ও সার্ভাইভারদের মাঝখানের একটা অস্তিত্বের কথাও বলেন, যাদেরকে তিনি রেমনেন্ট (যা মূলত শেষ বিচারের দিনে টিকে থাকা হক দলের ধারণা) বা অবশিষ্ট নামে অভিহিত করেছেন, যারা শহীদদের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারেন।১ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত জীবনে পরিণত হওয়া যে ইহুদিদেরকে মুসলমান (দার মুসলমান) ডাকনাম দেয়া হয়েছিল (কারন তারা হাড় জিরজিরে দেহ ও পুরোপুরি ভেঙে পড়া মন নিয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে থাকতেন, প্রায় রুকু করার ভঙ্গিমায়), তাদের মধ্যে যারা বেঁচে গেছিলেন, তারা হলেন রেমনেন্ট সত্ত্বার একটি উদাহরণ। আমরা তাদেরকে অবশিষ্ট শহীদ বা জীবন্ত শহীদও বলতে পারি। তবে তাদের সাক্ষ্য যেই সত্য প্রকাশ ধরে, তা বোধগম্য করা সম্ভব কেবল এমন এক মোকামের সত্য হিসাবে – যেখানে ভাষা ও কর্তাসত্ত্বা একযোগে সংঘটিত হয়। অবশ্য ইবনে সিনাও একদা একদল জীবিত শহীদের (মূলত সর্বোচ্চ মোকামপ্রাপ্ত আরিফ বা দিব্যজ্ঞানী) কথা লিখেছিলেন, যারা কেবল সত্যের রূপ দর্শন করে, কিন্তু – কথা বলে না।
জনগণ যখন বিপ্লব করে ও অকাতরে শহীদ হয়, যখন সে ঐতিহাসিক কর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়, তখন শাহাদাতের একধরণের যৌথ অভিজ্ঞতাও লাভ করে। “আই লিভ, আই ডাই, আই লিভ এগেইন” – হতে পারে একটা সিনেমাটিক ডায়ালগ।২ কিন্তু জুলাই বিপ্লবে অংশ নেয়া জনগণের অনেকেই এমন অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন যে তাদেরকে এই কথাটির অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা তারা এর সত্যতা অনুভব করেছেন। তারা বেঁচে আছেন অবশিষ্ট শহীদ হিসাবে। বয়ে চলেছেন এমন সব ব্যথা, যা পুরোপুরি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যা ভাষা ও তৎপরতার মধ্যে প্রকাশিত হতে গিয়ে জনগণের ঐতিহাসিক ট্রমা এবং যৌথ অচেতনের ক্ষতকে এড়াতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, শাহাদাতের ক্ষত যদি টিকে থাকে, তবে শাহদাতের পাটাতনে নির্মিত ইমারতটি ধসে পড়তে সময় লাগে না। তারপরও আমরা বারবার আমাদের জীবের জীবন কুরবানি দিতে ময়দানে নামি। খুব বেশি কিছুর জন্যে নয়। হয়ত স্রেফ বাক্য ভাষায় আবার আরেকটা সংবিধান লিখবো বলে। তাও লিখতে দেওয়া হয় না। জনগণের কুরবানির কালিতে বিশেষজ্ঞরা সংবিধান সংশোধন করেন, কিন্তু গণপরিষদ হয় না। অবলা জনগণ থেকে অবলা শহীদের চক্রে যেন আটকে আছে আমাদের ইতিহাস। যুগ বদলায়, শহীদি অমর রহে – কথাটিকে আমি এধরণের একটি ইতিহাসের সারমর্ম হিসাবেই পাঠ করতে চাই।
এ এক ট্রাজিক ইতিহাস। কিন্তু সেই সাথে, এই ইতিহাসের মধ্যেই (এই ইতিহাসের কথা বলতে পারা বা ইতিহাস রচনা করার মধ্যে) হয়ত উপস্থিত আছে এই ট্রাজিক দিগন্তকে অতিক্রম করে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই ইতিহাস যে সত্য তুলে ধরে, তা যেকোনো দলীয় বয়ানের চাইতে শাহাদাত সংক্রান্ত সত্যের অনেক নিকটের।
যুগ বদলায়। শহীদি অমর রহে।
২
ফ্রয়েড তার সর্বশেষ বই মুসা ও একত্ববাদ (মোজেস এন্ড মনোথিজম)-এ দাবি করেন যে ইহুদিরা মনোথিজম বা তৌহিদি মতাদর্শ ভুলে গিয়েছিল, যেভাবে মানুষ তার ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অবদমিত ট্রমা যেমন উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আবার প্রবল শক্তি নিয়ে ফেরত আসে, ইহুদিদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। তবে, ফ্রয়েড খুব সম্ভবত তার নিজের (বা নিজের শ্রেণীর) অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এমন দাবি করেছিলেন। কেননা, ইহুদি সমাজের সকলেতো আর ফ্রয়েডের মতো নিজের ধর্মীয় পরিচয় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে নাই। ফ্রয়েড ছিলেন নাস্তিক এবং এসিমিলিটেড ইহুদি। মানে তিনি ছিলেন তার সময়কার ঐসকল জার্মান ইহুদিদের একজন, যারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়টিকে পুরাপুরি বাদ দিয়া জাতীয় সমাজের অংশ হওয়ার চেষ্টা করতেন।
কিন্তু ফ্রয়েড মুসা ও একত্ববাদ লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন তিনি নিজ দেশ ত্যাগ করে মোহাজের হতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, শেষ বইটা তিনি লিখেছিলেন মোহাজের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। এবং খেয়াল করার ব্যাপার হলো যে ফ্রয়েড এই বইতে তৌহিদি কালাম তত্ত্বের প্রশংসা করেছেন। দাবি করেছেন যে তৌহিদি চিন্তার কারণেই, তথা একজন গায়েব খোদায় বিশ্বাস রাখার কারণেই এবস্ট্রাক্ট চিন্তার করার কাজে ইহুদিরা উৎকর্ষ অর্জন করেছে। এই কারণেই তারা গণিত ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় পারদর্শী হতে পেরেছেন। এবং তৌহিদি তথা একত্ববাদী ধর্ম চিন্তার কারণেই ইউরোপও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি করতে পেরেছে। । মুসা ও একত্ত্ববাদ বইটা বিখ্যাত, অবশ্য যতোনা সাইকোএনালিসিস বিষয়ক বই হিসাবে, তার চাইতে বেশি মুসা বিষয়ে ফ্রয়েডের হাইপোথিসিসের কারণে। এই হাইপোথিসিস মোতাবেক, ঐথাসিক মুসা একজন ব্যক্তি নন। বরং একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে মুসার চরিত্রটি তৈরি হয়েছে। প্রথম মুসা ছিলেন ফেরাউন আমেনহোটেপ/আখেনাটেনের সময়কার একজন একত্ববাদী মিশরিয় পুরোহিত, যিনি আমেনহোটেপের মৃত্যুর পর ক্যানান অঞ্চলে হিজরত করেন। এবং তিনি তার অনুসারীদের হাতে নিহত হন। ফ্রয়েডের এই হাইপোথিসিসটি বর্তমান যুগে অচল। তাওরাতে বর্ণিত মুসার অস্তিত্বের যে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই, ফ্রয়েডের এই দাবিটি সত্য। কিন্তু আমেনহোটেপ/আখেনাটেন একজন একত্ববাদী ফেরাউন ছিলেন বলেই মুসা তার আমলের একজন মিশরিয় পুরোহিত ছিলেন – এই হাইপোথিসিসটিও প্রমাণিত নয় (এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি)।
আমাদের আলোচনা অবশ্য এই লেখার সাইকোএনালিটিকাল বিচার নিয়েই। ফ্রয়েড এই বইয়ে দাবি করেছেন যে মসিহের ধারণা ইহুদিদের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল মুসাকে খুন করার অনুতাপের কারনে। এই খুনের অপরাধ আর অনুতাপকে ভুলতেই নাকি তারা পরবর্তীতে মুসার মতো একজন মুক্তিদাতা মসিহের আবির্ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। এবং একই ঘটনা পরবর্তীতে ঘটেছে ঈসার ক্ষেত্রে, যিনি মসিহ টাইটেলের দাবিদার ছিলেন। বলতে হয় যে, এইক্ষেত্রেও ফ্রয়েডের ইতিহাস বর্ণনা যথেষ্ট কষ্টকল্পিত। কেননা ব্যাবিলনে নির্বাসনের আগে ইহুদিদের মধ্যে মসিহের ধারণা বিকশিত হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নাই। তবে, মসিহের ধারণার সাথে যে ট্রমা আর গিল্টের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, ফ্রয়েডের এই সাইকোএনালিটিকাল বিবেচনা আমাদের জন্যে মূল্যবান। মেসিয়ানিজম বা মাহদিবাদের সাথে ক্ষত ও অনুতাপের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তা ইব্রাহিমি আখেরিতত্ত্বীয় ঐতিহ্যে শেষ জমানায় মাহদি ও মসিহের আবির্ভাব এবং শেষ বিচারের বিশ্বাসের মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয়।
নিৎসে জার্মান ভাষায় অনুতাপ, পাপ, ও দেনা – এই তিনটা ধারণার মধ্যে সংযোগ দেখতে পেয়েছিলেন শ্যুল্ড (schuld) শব্দটার মধ্যে। শ্যুল্ড মানে যেমন অনুতাপ, তেমন দেনাও। এবং খ্রিস্টিয় থিওলজিতে অনুতাপ এবং দেনা, দুইটা ধারণাই পাপ ধারণাটির সমার্থক। রিডেম্পশন কথাটির অন্যতম অর্থ হলো দেনা দায় থেকে মুক্তি। নিৎসের অনেক পরে ওয়াল্টার বেনিয়ামিনও শ্যুল্ড শব্দটির বিচার বিশ্লেষণ করলেন। এবং তিনি দাবি করলেন যে পুঁজিবাদ হলো এমন একটা কাল্টিক ধর্ম যার কাজ হলো অনবরত গিল্ট উৎপাদন করে যাওয়া, কোন রিডেম্পশন বা নাজাতের সম্ভাবনা ছাড়াই। ১৯৭১ সালের পর বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে দেনা। অনন্ত দেনার উৎপাদন ছাড়া নিওলিবারাল ইকোনমি টিকে থাকতে পারবে না। তেমনি, অনন্ত অনুতাপের উৎপাদন না করতে পারলে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি মতাদর্শিক ক্রাইসিসে পড়ে যাবে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী দুনিয়া আমাদেরকে ক্ষত ও অনুতাপের সমাপ্তি, তথা বিপ্লব বা ন্যায় বিচারের মাধ্যমে পরিপূর্ণ নাজাত অর্জনের উপযুক্ত কল্পনা করার বা বয়ান তৈরির সুযোগ দেয় না।
খৃষ্টধর্মের বিরুদ্ধে নিৎসের প্রধান দুই সমালোচনা ছিল এই যে ক্রুশবিদ্ধ ঈসার রূপ আদী খ্রিষ্টানদের মনে যেই ট্রমা ও অনুতাপের জন্ম দিয়েছিল, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যেই তারা কুরবানি-শাহাদাত এবং রিডেম্পশনের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিল। এই তত্ত্ব মোতাবেক, ঈসার এই নির্মম মৃত্যু অর্থহীন ছিল না। বরং গন্ধম খাওয়ার মাধ্যমে আদী পিতা আদম ও আদী মাতা হাওয়া যেই পাপ করেছিলেন, যেই পাপ মানব জাতি বংশগতভাবে বহন করে চলেছে – ঈসার কুরবানির উসিলায় সেই পাপ থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। নিৎসে এই থিওলজিকাল তত্ত্বকে রীতিমতো ঘৃণা করতেন। কেননা তার মতে, নিস্পাপের কুরবানির মাধ্যমে পাপীদের পাপমুক্তির তত্ত্ব একধরণের ভয়াবহ পৌত্তলিকতা। দ্বিতীয়ত, নিৎসে মনে করতেন যে বংশানুক্রমিক পাপের ধারণাও একটা খারাপ জিনিস। একজনের পাপ কেন তার পরিবার, উত্তরসূরি, সমাজ, বা জাতির লোকেরা বহন করবেন?
ইসলামের অবস্থানও এই দুই ক্ষেত্রে খানিকটা নিৎসের মতো। কেননা, কোরানে এবং নবীর কিছু বক্তব্যে পরিষ্কার ভাষাতেই বলা হয়েছে যে একজনের পাপের বোঝা আরেকজনের বহন করা লাগে না। তাছাড়া গন্ধম ফল খাওয়াটাকে “পাপ” হিসাবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিতও করা হয় নাই কোরানে (আল্লামা ইকবাল এবং আরো কেউ কেউ যেই কারণে স্পষ্টভাবেই বলেন যে গন্ধম খাওয়া কোন পাপ ছিল না)। বাংলার কবিরাতো পরিষ্কার ভাষাতেই গেয়েছেনঃ
“গন্ধম যদি না খাইত আদম হাওয়া আইতো না
আদম হাওয়া না আইলে দুনিয়াটা চিনতাম না
পাপ বলো পুণ্য বলো কিছুই আর বুঝতাম না…
বেহেশত বলো দোজখ বলো কিছুই আর জানতাম না..”
কোরানে আদম ও হাওয়া বলেন যেঃ “ও আল্লাহ, আমরা তো নিজেদের উপর জুলুম করেছি”। নিজের উপর জুলুম, এবং খ্রিষ্টধর্মের পাপের (দেনা+অনুতাপ) ধারণা এক নয়। খ্রিস্টিয় থিওলজির মতো তাই ইসলামে অনন্ত অনুতাপ অথবা যৌথ অনুতাপের ধারণা নাই। বাপের পাপ পুত্র বহন করে না। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি তার সমাজ, গোষ্ঠী, বা জাতির অন্যদের পাপের ভার বহন করে না। এবং সেইসাথে কোরানে বারবার অনুতাপ ও পাপ মুক্তির গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। তার জন্যে নিস্পাপের কুরবানি লাগে না। বরং, নিজেকে এবং অপরকে ক্ষমা করার চর্চার মাধ্যমে মানুষ আল্লার রহমত বা ক্ষমা পাইতে পারে। সুফিরা বলেন অন্যদের ক্ষমা করতে। এবং নিজেকেও ক্ষমা করে দিতে। পরের জন্যে দয়ালু হওয়ার পাশাপাশি নিজের উপরও দয়া করতে (সোবহানি-হাশিম-ভাসানীর রবুবিয়াতের তত্ত্ব যেমন সেলফ-কেয়ারের ধারণা ছাড়া পূর্ণতা পায় না)।
গাজায় সংঘটিত সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার ঘটনা অনেক কিছুই পালটে দিয়েছে। পাশ্চাত্যের মুসলমানরা কিছুদিন আগেও আল-কায়েদা ও আইসিসসহ আরো নানান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে ঘুরতো। কিন্তু গাজার জনগণের শাহাদাত আজকে সারা দুনিয়ার মুসলমানদেরকে একটা মোরাল আপার গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। কেউ কেউ এই ঘটনাটিকে গাজার জনগণের কুরবানির ফল হিসাবেও পাঠ করেন। আমি এধরণের ব্যাখ্যা করতে চাই না। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইহুদি গণহত্যাকে কুরবানি (হলোকস্ট, যার অর্থ হলো পোড়ানো কুরবানি) হিসাবে ব্যাখ্যার ফলাফল ভাল হয় নাই। বহু জায়নিস্টরা ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লেজিটিমেসি নেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের শহীদদের কুরবানি থেকে। নিস্পাপদের উপর চালানো বর্বর নির্যাতন ও গণহত্যাকে একটা পুরো জাতির পাপ মুক্তির কুরবানি হিসাবে পাঠ করার যে ধর্মতত্ত্ব, তার সেক্যুলার সংস্করণগুলোর ব্যাপারেও সতর্ক থাকা জরুরি। যা প্রয়োজন, তা হলো শহীদের নাম ও স্মৃতি ধরে রাখা, এবং বিচারের দাবি বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। এবং এই আকাঙ্ক্ষাও বাঁচিয়ে রাখা যে যেন হিসাবের দিনটিতে, বিচারের দিনটিতে আমরা ন্যায় বিচার করতে পারি। পাশ্চাত্যের ক্ষমতাধর জাতিরাষ্ট্রগুলোর মতো এক পাপের বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার উসিলায় যেন আরেক পাপে না জড়িয়ে পড়ি।
৩
যদিও ভাল এবং ক্রিটিক্যাল কমিক্সের অভাব নাই, কিন্তু হাই আর্ট হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, এমন কমিক্স কমই আছে। আর্ট স্পিগেলম্যানের মাউসঃ দা সার্ভাইভর্স টেল নিঃসন্দেহে একটি হাই আর্ট।
স্পিগেলম্যানের এই কার্টুন-কিতাবটি অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারো পক্ষেই এই কিতাব স্বস্তির সহিত পাঠ করা সম্ভব না। যেমন এই কিতাবে তিনি ইহুদিদেরকে এঁকেছেন ইঁদুর হিসাবে, আর জার্মানদেরকে তার পেন্সিলের খোঁচায় হয়ে গেছেন – বিলাই (আর আমেরিকানরা – কুকুর)। যেখানে নাজিরাই ইহুদিদেরকে ডিহিউমিনাইজ করবার জন্যে ইঁদুর বলতো, সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সার্ভাইভার ইহুদি পিতামাতার সন্তান স্পিগেলম্যান এই কাজ কেন করলেন? প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও স্পিগ্যালম্যান যে সেন্সরশিপের মুখে পড়েন নাই। কারণ তিনি হলোকস্ট সার্ভাইভার-দের সন্তান। এবং মাউসঃ দা সার্ভাইভর্স টেল গল্পটাও তার পিতার স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই লেখা। এই কমিক্সের গল্প আসলে খুবই শিল্পীর খুবই ব্যক্তিগত একটি গল্প। একটি পারিবারিক ট্রমার গল্প। গণহত্যার সার্ভাইভার পিতামাতার ট্রমা আমেরিকায় জন্ম নেয়া সন্তানের জীবনে বাহিত হওয়ার গল্প। ট্রমা বা ক্ষত জিনিসটা এমনই, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু স্পিগেলম্যানের আঁকা ক্ষত মূলত ব্যক্তিগত, ও পারিবারিক। যদিও তার পরিবার একটি ঐতিহাসিক ও কালেক্টিভ ট্র্যাজেডির শিকার, কিন্তু তাদের তো একটা আলাদা পারিবারিক স্মৃতির বলয়ও আছে। স্পিগেলম্যান চান নাই তার বইটা হলোকস্ট বিষয়ক কালচার ইন্ডাস্ট্রির অংশ হোক। তিনি চান নাই এই বইটা হলোকস্টের স্মৃতি ধরে রাখার নিয়ম মাফিক রিচুয়াল ও রাজনীতির অংশ হোক। কিন্তু পরে তা-ই হয়েছে। বইটা বিখ্যাত হয়েছে। পুরস্কার জিতেছে। কালেক্টিভ স্মৃতিচারণার অংশ হয়েছে। আর নিজের প্রজেক্টের এই পরাজয় দেখে স্পিগেলম্যান পতিত হয়েছেন ভয়াবহ বিষণ্নতায়।
গত বছর একাত্তরের ২৫/২৬ মার্চ বিষয়ে ফেসবুকে আমার নিজের একটি পারিবারিক স্মৃতি শেয়ার করেছিলাম, যাতে রমনা কালী মন্দির ও কালী বাড়ির স্মৃতিচারণা ছিল। আমি কালী মন্দির বা কালী বাড়ি না দেখলেও দাদি ও পিতার কাছে এতবার শুনেছি যে কল্পনায় আমি এই দুই স্থাপনাকে ভস্মীভূত হতে দেখেছি বহুবার। কল্পনায়, আমার পিতার (যার বন্ধুরা কালী বাড়িতে বাস করতেন) জায়গায় আমি নিজে বহুবার দাঁড়িয়ে থেকেছি, হতবিহ্বল, ব্যথিত একজন দর্শক হিসাবে। সমস্যা হলো যে এই স্মৃতিচারণার পর রমনা কালী মন্দির নিয়ে বেশ কিছু ফেসবুক পোস্ট পাবলিশ হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী পেজ থেকে করা পোস্টও আছে, যাতে কালী মন্দিরের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বয়ান প্রচার করবার স্বার্থে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ঐতিহাসিক কোন পর্ব নিয়ে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করা কতটা বিপজ্জনক, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো এই ঘটনা। আমাদের স্মৃতি যেকোনো সময় লুট হয়ে যেতে পারে। ব্যবহৃত হতে পারে প্রভাবশালী ও হেজিমনিক কোনো বর্ণবাদী বয়ানের শক্তি বৃদ্ধিতে।
তবে, স্পিগেলম্যানের গল্পটা পারিবারিক স্মৃতিচারণা হলেও এরমধ্যে কোন রাজনীতি নাই, তা বলা যাবে না। অন্তত আমি এরমধ্যে রাজনীতি দেখি। এ হলো জীবের জীবনের রাজনীতি। বায়োপলিটিক্স নয়। স্পিগেলম্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আমরা মানুষরা সকলেই জীব। এবং মানুষের মধ্যে আছে সকল জীবের মতোই আচরণের সম্ভাবনা। রাজনৈতিক হায়ারার্কি ও বর্ণবাদের ফ্রেমওয়ার্কে কেউ বিলাই (শিকারি) আবার কেউ ইন্দুর হতে পারে। মানে, যারা ফ্যাসিস্ট, যারা কোন না কোন দল বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে ডিহিউমিনাইজ করতে সামান্য ভয় পান না, তারাও কিন্তু নিজেদেরকে পশুই বানায়। যে অন্য কাউকে ইঁদুর বানায়, সে নিজেই পরিণত হয় শিকারি বিড়ালে। তারাও আবার পরিণত হতে পারেন কুকুরের শিকারে। দক্ষিণ এশিয়ায় আজকে আমরা বহু ধরনের ফ্যাসিস্ট দেখি। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট, ইসলামোফ্যাসিস্ট, জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট – ইত্যাদি। এই ফ্যাসিস্টরা সকলেই নিজেদেরকে বিলাই আর তাদের টার্গেটদেরকে ইঁদুর মনে করে। জীবনানন্দের কবিতার অন্ধ পেঁচার মতো এই অন্ধ বিড়ালেরা প্রতিদিন আবৃত্তি করে চলেছেঃ ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।
বাঙালি মুসলমান সমাজে শয়তান নিয়ে অনেক গল্প আছে। যেমন একটি গল্প মোতাবেক শয়তান এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে ঠিক করলো সে শয়তানি করবে। তখন সে দেয়ালে একটু হালুয়া ছিটিয়ে দিল। সেই হালুয়া খাওয়ার জন্যে হাজির হলো তখন একটা ইঁদুর। আর ইঁদুর খাইতে হাজির হলো বিড়াল। আর বিড়ালের পেছনে পেছনে কুকুর। এরপর বিয়ে বাড়ি হয়ে গেল রণক্ষেত্র।
৪
একজন বিপ্লবী আর একজন ফ্যাসিস্টের মধ্যে পার্থক্য কী? হোসেনি সেনা আর এজিদিদের মধ্যে পার্থক্য কী? এজিদিদের উত্থান ঘটেছিল খলিফা ওসমান হত্যাকাণ্ডের জন্যে ন্যায় বিচারের দাবিতেই। খারেজিওরা নিজেদেরকে মজলুম বলেই দাবি করতেন, এবং নিজেদের লড়াইকে দেখতেন জুলুম বিরোধী লড়াই হিসাবে। ভিকটিমহুড বা মজলুমিয়াতের একটা সীমা আছে। অনন্তকাল ভিকটিমহুড বা মজলুমিয়াতকে পুঁজি করতে গেলে বয়ানের উপর থেকে অর্থ ও সত্যের সাকিনা চলে যায়। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল। যারা অর্থহীন কথা বলে মজলুমিয়াতের বাণিজ্য করে, তারা মজলুমিয়াত পুঁজি করে জুলুমও করতে পারে। অতীত গণহত্যার ট্রমা নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে নতুন গণহত্যা করতেও তারা পিছপা হয় না। সারা দুনিয়ার মানুষ আজকে এই বাস্তবতার সাক্ষী।
৫
সলিমুল্লাহ খান একদা দাবি করেছিলেন যে, আমাদের মনের থানাটোস তথা ডেথ ড্রাইভ হলেন – ইমাম হোসেন। বাঙালি মুসলমানের যৌথ চেতনার ঘরে যে কারবালার ট্র্যাজেডি, ইমাম হোসেন, জয়নব, ও সাকিনার মতো চরিত্ররা এতো সহজে জায়গা করে নিতে পেরেছে, তার জন্যে হয়তো আমাদের পূর্বজদের মন তৈরিই ছিল, বাংলায় ইসলামের আবির্ভাবের আগেই। বাঙালি মুসলমানের মনে ছফা যেমন বলেছেন, বাংলাদেশিরা হলো হাজার বছরে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত, অজাত ও অস্পৃশ্য, চণ্ডাল ও ছোটলোকদের জাত। যে ট্রমা আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছি, তার কারণেই হাসান, হোসেন, জয়নব, সাকিনারা আমাদের এতো পরিচিত। আপনার চেয়ে বেশি আপন।
এবং তারাও হয়তো আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। একদিন আরব জাতীয়তাবাদ আর কুরাইশ শ্রেষ্ঠত্ববাদের কবল থেকে নবীর মদিনার স্মৃতি মুক্ত হবে, তা জেনেই ইমাম হোসেন হয়তো নিজের প্রাণ কোরবান করেছেন। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতেই জয়নব, সাকিনারা মর্সিয়া কাব্য লিখেছেন। হারানো মদিনার স্মৃতিকে ধরে রেখেছেন। এবং একদিন তাদের নামে সেসব স্মৃতি জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির পুথি সাহিত্যে – মর্সিয়া কাব্যে। আমরা এই দুনিয়ায় অপেক্ষিত ছিলাম।
আজর নামক ব্রাহ্মণ ও তার পরিবার কেন তাদের অচেনা একজন আরব ব্যক্তির কাটা মস্তক দেখে হোসেনি হয়ে যাবে? কেন সেই কাটা মস্তক রক্ষার জন্যে তার পুরো পরিবার শহীদ হয়ে যাবে। কেন আজর আর তার পরিবার এই ট্র্যাজেডির জন্ম দিতে থাকবে শত শত বছর ধরে পুথির পাতায়? কেননা আমরা এই দুনিয়ায় অপেক্ষিত ছিলাম। আমাদের পূর্বজরা তাদের ব্যথা বেদনা আর ইউটোপিয় স্বপ্নগুলো এভাবেই আমাদের জন্যে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তারা যেই ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারতেন, সেই ভাষাতেই লিখেছেন। এবং এই ভাষাতেই ধরে রেখেছেন একটা অনাগত মদিনার ইউটোপিয় স্বপ্ন।
৬
বাংলাদেশের ইতিহাস আটকে গেছে ট্রমা তথা ক্ষত ও ব্যথার চক্রে। ব্যথা একটা ভারী এবং ছোঁয়াচে জিনিস। আমরা সাধারণত ব্যথা পাই পরের কর্মের কারণে, কিন্তু ফল হিসাবে ব্যথাটা বয়ে চলি (যদি না কেউ নিজেকে হিল করবার মতো, বা ব্যথার চক্র ভাঙার মতো হেকমত লাভ করেন)। ব্যথা প্রভাবশালী। ছোঁয়াচে। ইফ ইউ ডোন্ট হিল হোয়াট হার্ট ইউ, উই উইল ব্লিড অন পিপল হু ডিড নট কাট ইউ।
ব্যথার ফল বা প্রভাব আমরা বহন করে চলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ব্যথা পরিণত হয় আমাদের ঐতিহাসিক জিঞ্জিরে। ব্যথা আমাদের রাজনৈতিক কম্পাস। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে ক্ষমতাবান যে দুই রাজনৈতিক পরিবার, তাদের ব্যথার ভারও কম নয়। এই দুইটা পরিবারের ইতিহাস কি বাংলা সিনেমার চাইতে কম আনরিয়েল? ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি বা নিরাপত্তা কি তাদেরও প্রাপ্য ছিল না? অথচ আমাদের মতোই, তারাও আটকে গেছেন ব্যথার চক্রে। ক্ষত ও প্রতিশোধের এডিকশনে। তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে, এমন একটা চাহিদা ছিল আশির দশকে বেড়ে এঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজেরও। ক্ষত, প্রতিশোধের বাসনা, আর ক্ষমতার লিপ্সা – এই তিন যেন একাকার হয়ে গেছে এই পরিবারগুলোর জীবনে। এবং আমাদের রাজনৈতিক বাসনায়।
আমরা আমাদের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক করি ব্যথার প্রভাবে। এই ব্যথা দেন খুব দূরের কেউ না। বরং দেন পরিবারের সদস্য, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, ও প্রেমাস্পদেরা। ব্যথা দেয়া, বা অপমান করতে পারাকে আমরা ভার্চু মনে করি। এবং নিজে ব্যথা না পাইতে, অপমানিত না হইতে যা যা করা দরকার (যতো খারাপ কাজই হউক না কেন), তা আমরা করি। যেন, আমরা কম অপমানিত হই। এবং অন্যদেরকে অপমান করতে বা ব্যথা দিতে পারি। বাংলাদেশে অনেক সেলিব্রেটি লেখক মূলত অপমান সেল করেন। অপমান অপদস্থ করবার গুণের কারণেই তারা সেলিব্রেটি। তারা নিজেরাও এই স্টাইল ছেড়ে দিলে আর লিখতে পারবেন না। তাদের আর পাঠকও থাকবে না। তারা খুবই পপুলার একটা মাদকের ডিলার।
কিন্তু ব্যথার চক্রে আটকে থাকলে সৃষ্টিশীল কাজ করা অসম্ভব। এবং অসম্ভব সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত কোন রূপান্তর। ব্যথার চক্রে আটকে গেছি বলেই স্বাধীনতা বারবার আমাদের হাত ফসকে বের হয়ে যায়। ব্যথা আর দু;খের মধ্যে ফারাক হলো রাত আর দিনের। ব্যথা সুস্থ মানুষকে সাইকোপ্যাথ বানায়। কিন্তু দু:খ আমাদের বানায় বুদ্ধ। অথবা মজনু। দুঃখ আমাদেরকে সমব্যথী করে। পরের ব্যথা বুঝতে ও তার সাথে সমব্যাথার এলাকায় মোলাকাতের সুযোগ করে দেয়। ব্যথা হলো শেকল। দু:খ হলো ডানা।
১ ইসলামী আখেরিতত্ত্বের কিছু বর্ণনা মোতাবেক, শেষ জমানায় ৭৩টি তথা বহু ফিরকা থাকবে, কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল একটি দলই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। শেষ জমানায় এধরণের হকপন্থী দলের বিশ্বাস ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আছে। এই হকপন্থী দলকেই ইংরেজিতে বলে – রেমনেন্ট। আগামবেনের রেমনেন্ট অফ আউসউইটস বইটির নামে যে “রেমনেন্ট” বা অবশিষ্ট ধারণাটি আমরা পাই, তা ইব্রাহিমি ঐতিহ্যের রেমনেন্টের ধারণা থেকেই নেয়া। হয়তো ইব্রাহিমি আখেরিতত্ত্বে রেমনেন্টের যে ধারণা, তা বেহাত বিপ্লব পরবর্তি সময়ে টিকে থাকা অবশিষ্ট ইমানদারদেরই ধারণা, যারা শহীদদের হয়ে সাক্ষ্য দেন, এবং মসিহ বা মাহদির পুনরাবির্ভাব ও তার অনাগত রাজত্বের প্রতি বিশ্বাস হারান না। তাদের মাধ্যমেই বাকীরা নাজাত লাভ করে। সম্প্রতি গাজায় গণহত্যার শিকার হওয়া ও মুক্তিসংগ্রাম জারি রাখা জনগণকেও শেষ জমানার হকপন্থী দল হিসাবে পাঠ করেছেন অনেকে। মার্ক্সীয় ঐতিহ্যে উপস্থিত থাকা প্রলেতারিয়েত ধারণাটিও রেমনেন্ট/হকপন্থী দলের ধারণার একটি সেকুলার বস্তুবাদী সংস্করণ।
২ ম্যাড ম্যাক্স; ফিউরির রোড সিনেমার ওয়ারবয় নাক্সের শাহদাতের তামান্না প্রকাশ করা ডায়লগ।